গুমের সঙ্গে জড়িত শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিচার নিশ্চিত না হলে এ দেশে গুমের সংস্কৃতি আবারো ফিরে আসার আশঙ্কা রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে গুমের আলামত নষ্ট এবং সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনকি রয়েছে হুমকি ও নানা ধরনের অসহযোগিতাও। এ ধরনের নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

তবে গুম কমিশন মনে করছে, বিচারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- গুমের সঙ্গে জড়িত তৎকালীন বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিরা পালিয়ে যাচ্ছেন। এতে করে বিচার নিয়েও সংশয় তৈরি হচ্ছে। তবে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই গুমের ঘটনাগুলো অনুসন্ধানের মাধ্যমে এর সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার সব ধরনের তথ্যই সংগ্রহ করছে। যাতে করে অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়।

গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন ও ড. নাবিলা ইদ্রিস খুলনায় গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার এবং গুম থেকে ফিরে আসা ভিকটিমসহ শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শ সভা ও সেমিনারে এসব কথা বলেন।

যথাক্রমে ২৫ জুলাই খুলনার খালিশপুরস্থ ব্রাক লার্নিং সেন্টার এবং ২৬ জুলাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গবেষণাগার হলে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক দপ্তরের সহযোগিতায় মানবাধিকার সংগঠন 'অধিকার' এ পরামর্শ সভা ও সেমিনারের আয়োজন করে।

গতকাল শনিবার (২৬ জুলাই) খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গবেষণাগার হলে 'বলপূর্বক গুমের ঘটনা মোকাবেলা : কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়' শীর্ষক সেমিনারের সঞ্চালনায় ছিলেন অধিকারের পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলান। বক্তৃতা করেন জাতিসংঘের ঢাকাস্থ মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন।

আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. রেজাউল করিম, খুলনা জেলা আইন কর্মকর্তা (জিপি) এডভোকেট ড. মো. জাকির হোসেন, জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) তৌহিদুর রহমান চৌধূরী তুষার ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিষয়ক পরিচালক ড. নাজমুস সাদাত শুভ। বক্তৃতা করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের খুলনা জেলা সভাপতি এডভোকেট কুদরত-ই- খুদা, ব্লাস্ট খুলনার উপদেষ্টা এডভোকেট অশোক কুমার সাহা, সাংবাদিক এইচ এম আলাউদ্দিন, মাহবুবুর রহমান মুন্না, গুম থেকে ফিরে আসা খুলনা বিদ্যালয়ের ছাত্র নূর মোহাম্মদ অনিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইমরান হোসেন, মানবাধিকার কর্মী জি এম রাসেল ইসলাম, পাটকল শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলাম ও শেখ মো. ফারুক। সেমিনারে সিনিয়র সাংবাদিক শেখ দিদারুল আলম, অধিকার খুলনার ফোকাল পারসন সাংবাদিক মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, মানবাধিকার কর্মী কে এম জিয়াউস সাদাত, এডভোকেট মো. শহিদুল ইসলাম, হাফেজ মো. কামরুজ্জামান, তাসনিম হাসান আফ্রিদি, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি আহম্মদ হামিম রাহাত, আয়মান আহাদ, মুহিব্বুল্লাহ মুহিব, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আলকামা রমিন ও সাধারণ সম্পাদক মিরাজুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

গুম কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন আরও বলেন, চারটি স্তরে সাধারণ মানুষকে গুম করা হতো। এগুলো হচ্ছে একটি গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নজরদারির মধ্যে রাখত। অপর গ্রুপ তাকে তুলে নিত। এই গ্রুপটি গুমের শিকার ব্যক্তিকে হয় জঙ্গি বানিয়ে সন্ত্রাস ও অস্ত্র মামলা দিয়ে আদালতে চালান দিত, অথবা মেরে ফেলত। সর্বশেষ গ্রুপটি ভারতে পাচার করে দিত অথবা আয়না ঘরে গুম করে রাখত।

তিনি বলেন, গুম কমিশন চার ভাবে অনুসন্ধান করছে। এগুলো হচ্ছে সকল আয়না ঘর বা বন্দিশালা পরিদর্শন, সংশ্লিষ্টদের তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ, ভারতীয় কারাগারে বাংলাদেশীদের আটকের তথ্য চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পত্র প্রেরণ এবং ভারতে পুশইন এর তালিকা ধরে অনুসন্ধান করা। এভাবে গুম কমিশন অভিযুক্তদের বিচারের ব্যাপারে কাজ করছে।

সেমিনারে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার বিগত ১৬-১৭ বছরে যেভাবে বিভিন্ন ধরনের তকমা লাগিয়ে গুমের নাটক সাজিয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে এবং সাজা দিয়েছে- তাতে সবাই মনে করত এটাই বোধ হয় বাংলাদেশের রীতি। তৎকালীন সময় আমরা এসবের প্রতিবাদ করতেও ভুলে গিয়েছিলাম। সবার কন্ঠ রোধ করা হয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে, মানুষ নতুন করে স্বাধীনতা পেয়েছে। এজন্য তিনি ছাত্র-জনতাকে ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে এখনো ফিরে না আসা গুমের শিকার ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা এবং গুমের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবি জানান।

এর আগে ২৫ জুলাই খুলনার ব্রাক লার্নিং সেন্টারে গুম থেকে ফেরত আসা ব্যক্তি ও গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের খুলনা বিভাগীয় পরামর্শ সভায় গুম কমিশনের সদস্য ড. নাবিলা ইদ্রিস বলেন, কমিশনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের না জানিয়েই আয়না ঘর ও বিভিন্ন বন্দিশালা পরিদর্শন করা হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে জানিয়ে প্রদর্শনে গেলে সবকিছু গোছানো অবস্থায় পাওয়া যায়। কিন্তু না জানিয়ে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন জায়গায় ভুক্তভোগীদের বর্ণনার সঙ্গে আলামতের মিল পাওয়া যাচ্ছে। এভাবে একটানা কাজ করে কমিশনের সদস্যরা তথ্য প্রমাণ ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

অধিকারের পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের সঞ্চালনায় বক্তৃতা করেন গুম সংক্রান্ত কমিশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন ও ড. নাবিলা ইদ্রিস এবং জাতিসংঘের ঢাকাস্থ মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন। সেমিনারে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার ও গুম থেকে ফেরত আশা ব্যক্তিরা গুম সংক্রান্ত কমিশনের কাছে তাদের দুর্বিষহ নিদারুণ নির্যাতন নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেন।