রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন আহতদের মধ্যে আরো দুইজনকে ছাড়পত্র দিয়েছে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। এ নিয়ে হাসপাতালটি থেকে মোট চারজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। গতকাল রোববার বিকেল তিনটায় হাসপাতাল চত্বরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ তথ্য জানান ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, মোটামুটি সুস্থতা লাভ করায় আজ দুজনকে আমরা রিলিজ দিয়েছি। বর্তমানে ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৩৪ জন, যাদের মধ্যে ২৮ জন শিশু এবং ৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক।

হাসপাতাল পরিচালক জানান, ছাড়প্রাপ্তদের একজন উদ্ধারকারী কাজী আমজাদ সাইদ, যিনি দুর্ঘটনার সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার কাজে অংশ নেন। অপরজন সবুজা আক্তার, যিনি ছিলেন মাইলস্টোন স্কুলের একজন নারী কর্মী (আয়া)। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে ভর্তি থাকা ৩৪ জন রোগীর মধ্যে চারজন রয়েছেন আইসিইউতে। তাদের মধ্যে দুজন রয়েছেন লাইফ সাপোর্টে (ভেন্টিলেটর)। এই দুই রোগী হলেন ১৪ বছর বয়সী আয়ান, যার শরীরের ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে এবং ইনহেলেশন ইনজুরিও রয়েছে; এবং নাবিদ নেওয়াজ, যিনি ৫৩ শতাংশ দগ্ধ ও ইনহেলেশন ইনজুরিতে আক্রান্ত। এছাড়াও মেডিকেল এইচডিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৩ জন, ফিমেল এইচডিইউতে ৬ জন, পোস্ট-অপারেটিভ ওয়ার্ডে ৮ জন এবং কেবিনে আছেন ১২ জন। সব মিলিয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে ৪ জন সংকটাপন্ন (ক্রিটিক্যাল) এবং ৯ জন গুরুতর (সিভিয়ার) অবস্থায় রয়েছেন। ইনহেলেশন ইনজুরিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৭ জন এবং শরীরের ৩০ শতাংশ বা তার বেশি পুড়ে যাওয়া রোগীর সংখ্যা ৬ জন।

এদিন নতুন করে আইসিইউতে কাউকে ভর্তি করা হয়নি, তবে চারজনের অবস্থা গুরুতর থেকে সংকটাপন্ন পর্যায়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এদের মধ্যে আছেন ১৫ বছর বয়সী তাসনিয়া, যিনি ৩৫ শতাংশ বার্ন ও ইনহেলেশন ইনজুরিতে আক্রান্ত; ১০ বছর বয়সী আবিদুর রহিম, যিনি ২২ শতাংশ বার্নে আক্রান্ত; আগে থেকেই আইসিইউতে থাকা নাবিদ নেওয়াজ এবং সেহেল ফারাবি আয়ান, ৪০ শতাংশ বার্নে আক্রান্ত। এদিকে, রোববার পর্যন্ত নতুন কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত বার্ন ইনস্টিটিউটে মৃত্যুর সংখ্যা ১৭-তেই স্থির রয়েছে। চিকিৎসকরা জানান, ইনহেলেশন ইনজুরি ও উচ্চমাত্রার বার্নে আক্রান্ত রোগীদের অবস্থা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি অধিকাংশ রোগীই শিশু, যাদের শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক পুনর্বাসনের প্রয়োজন রয়েছে। চিকিৎসকদের মতে, এই রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি পরিচর্যা, সেলাই, স্কিন গ্রাফটিং, ইনফেকশন প্রতিরোধ ও ফিজিওথেরাপিসহ নানা চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন। ফলে আজকের ছাড়পত্র সাময়িক স্বস্তি দিলেও বাকি রোগীদের সামনে এখনো লম্বা ও কঠিন চিকিৎসা প্রক্রিয়া অপেক্ষা করছে।

মোট মৃত্যু কমেছে: মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় সিএমএইচ হাসপাতালে যে ১৫টি ‘বডিব্যাগ’ নেওয়া হয়েছিল, সেসবে চূড়ান্তভাবে ১৪ জনের লাশ শনাক্ত হয়েছে। সেই কারণে একজনের মৃত্যুর তথ্য বাদ দেওয়ার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার দুজনের মৃত্যুর পর মোট ৩৫ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল রোববার সকালে হালনাগাদ তথ্যে সেই সংখ্যা ৩৪ বলে জানানো হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে ৫ জনের পরিচয় শনাক্তের কথা জানায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। সেদিন সিআইডি জানিয়েছিল, ডিএনএ ল্যাবের সদস্যরা সিএমএইচে রাখা অশনাক্ত লাশ ও দেহাংশ থেকে মোট ১১টি ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেন। সেসব নমুনা বিশ্লেষণ করে মোট পাঁচজনের ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়। ওই পাঁচজন হচ্ছে- ওকিয়া ফেরদৌস নিধি, লামিয়া আক্তার সোনিয়া, আফসানা আক্তার প্রিয়া, রাইসা মনি ও মারিয়াম উম্মে আফিয়া। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রোববার হালনাগাদ তথ্যের সঙ্গে শুক্রবার সিএমএইচ থেকে পাওয়া একটি চিঠিও সরবরাহ করেছে।

চিঠিতে সিএমএইচ বলেছে, গত ২১ জুলাই সিএমএইচ কর্তৃক মোট ১৫টি ‘বডিব্যাগ’ গৃহীত হয়, যার মধ্যে তুরাগ থানা পুলিশ প্রাথমিকভাবে ১১টি লাশ, ২টি অপূর্ণাঙ্গ লাশ এবং ৫টি লাশের অংশবিশেষ সুরতহাল করেন। ১১টি লাশের মধ্যে ঘটনার দিনই ৮টি এবং পরদিন আরেকটি লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

সিএমএইচ আরও বলেছে, সুরতহালকৃত অবশিষ্ট ২টি মলাশ, ২টি অপূর্ণাঙ্গ লাশ এবং ৫টি লাশের অংশবিশেষ থেকে ২২ জুলাই সিআইডি ফরেনসিক টিম ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করেন এবং পরীক্ষা শেষে ফলাফলের ভিত্তিতে সিআইডি ফরেনসিক টিম মোট ৫ জনের লাশ শনাক্ত করে। সিআইডির কাছ থেকে ডিএনএ পরীক্ষার ফল পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাতেই তুরাগ থানা পুলিশ পাঁচ পরিবারের কাছে লাশ ও দেহাবশেষ হস্তান্তর করে বলে চিঠিতে জানিয়েছে সিএমএইচ। এ দুর্ঘটনায় হতাহতদের বিষয়ে তথ্য প্রদানের ফোকাল পারসন ডা. সরকার ফারহানা কবীর বলেন, ডিএনএ টেস্ট রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে সিএমএইচ আপডেট করেছে। তাদের পাঠানো রিপোর্ট অনুযায়ী আমারও আপডেট (মৃতের সংখ্যা) করেছি। হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, এ দুর্ঘটনায় ৩৪ মৃত্যুর মধ্যে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১৭ জন, সিএমএইচে ১৪ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন, লুবানা জেনারেল হাসপাতালে একজন ও ইউনাইটেড হাসপাতালে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে লুবানা হাসপাতালে মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিচয় এখনো জানা যায়নি। ঘটনার এক সপ্তাহ পেরিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে এখনও চিকিৎসাধীন আছে ৪৮ জন। এর মধ্যে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৩৬ জন, সিএমএইচে ১১ জন ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে একজন চিকিৎসাধীন রয়েছে। গত সোমবার দুপুরে দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসের একটি ভবনের মুখে বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এই সামরিক বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতদের বেশির ভাগই শিশু।

মাসুমাকে ভোলায় দাফন: মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত প্রতিষ্ঠানটির আয়া মাসুমাকে ভোলার বোরহানউদ্দিনে দাফন করা হয়েছে। গতকাল রোববার সকালে জানাযা শেষে উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে। শনিবার সকাল সোয়া ১০টায় ৩৮ বছর বয়সী মাসুমা পাঁচ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে মারা যান। পরে রাতেই তার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। তাকে একনজর দেখার জন্য স্বজন, প্রতিবেশী ও গ্রামবাসীরা ভিড় করেন। মাসুমা মাইলস্টোন স্কুলে আয়ার কাজ করতেন। স্বামী মো. সেলিম ঢাকায় একটি বায়িং হাউজে গাড়ি চালক হিসেবে কাজ করেন। মাসুমা স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তুরাগ থানার নয়ানগর শুক্রভাঙ্গা এলাকায় বসবাস করতেন।