বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)-এর মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৬তম সীমান্ত সম্মেলন ঢাকার পিলখানায় শুরু হচ্ছে আজ সোমবার থেকে। চার দিনব্যাপী এই বৈঠক চলবে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত। সম্মেলন শুরু হবে পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তরে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং তার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর এই প্রথম ঢাকায় আসছে বিএসএফের প্রতিনিধি দল।

সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে নেতৃত্ব দেবেন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী এবং ভারতীয় প্রতিনিধিদলে নেতৃত্ব দেবেন বিএসএফ মহাপরিচালক দলজিৎ সিং চৌধুরী। সরকারি সূত্র জানিয়েছে, সীমান্ত হত্যা, ভারত থেকে বাংলাদেশে লোক ঠেলে পাঠানো (পুশ ইন), সীমান্ত পথে মাদক ও অস্ত্র পাচারসহ সীমান্তবর্তী এলাকায় বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চোরাচালানসহ বিভিন্ন বিষয় ছাড়া আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখার ১৫০ গজের মধ্যে অননুমোদিত অবকাঠামো নির্মাণ, সীমান্তবর্তী নদীর তীর সংরক্ষণ ও সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় আসবে। দুই বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ে সর্বশেষ বৈঠক হয় নয়াদিল্লিতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে।

বিজিবি সূত্র জানিয়েছে, সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যার পাশাপাশি বিএসএফ বিভিন্ন রাজ্য থেকে বাংলাভাষীদের ধরে সীমান্ত দিয়ে জোরপূর্বক বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে। ৪ মে থেকে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যেই দুই হাজারের বেশি মানুষ ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১২৬ জন ভারতীয় নাগরিক। সবচেয়ে বেশি ঠেলে দেওয়া হয়েছে মৌলভীবাজার সীমান্ত দিয়ে ৫০২ জনকে। এ ছাড়া লালমনিরহাটে ১২৮, খাগড়াছড়িতে ১৬০, সাতক্ষীরায় ১১০ জনকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে এর প্রতিবাদ জানানো হলেও বন্ধ হচ্ছে না পুশ ইন। দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে কিছু দিন পর পরই পুশ ইন করা হচ্ছে বাংলাভাষাবাসি সেদেশের নাগরিকদের।

এরআগে শনিবার ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে সম্মেলনে দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বসহকারে আলোচনা হবে। ইস্যুগুলো হলো- আন্তঃসীমান্ত অপরাধ ঠেকানো, সীমান্ত এলাকায় এক সারিতে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, বাংলাদেশে আশ্রিত ভারতবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ, সীমান্ত অবকাঠামোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যু, সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার (সিবিএমপি) বাস্তবায়ন, পরস্পরের প্রতি আস্থা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি প্রভৃতি। এক বিবৃতিতে বিএসএফের পক্ষ থেকে বলা হয়, সীমান্ত অবকাঠামোগত সমস্যা, আন্তসীমান্ত অপরাধ প্রতিরোধ, একক-সারি বেড়া নির্মাণসহ বিভিন্ন বিষয় বৈঠকে উঠবে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সীমান্তে বিশ্বাসের অভাবের কারণে ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরকে দোষারোপ করছিল। তবে এই বৈঠকের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সেই ফাঁক পূরণের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এনডিটিভির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত আলোচনার টেবিলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম, বিএসএফ সদস্যদের ওপর সাম্প্রতিক হামলা এবং ভারতীয় নাগরিকদের ওপর বাংলাদেশি নাগরিকদের আক্রমণের বিষয়টি তুলবে। সীমান্ত অপরাধ এবং একক সারির কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের বিষয়টিও আলোচনায় আসবে। সীমান্ত অবকাঠামো আরও শক্তিশালী করতে হবে যাতে (ভারতীয়) বাহিনী আরও কার্যকরভাবে সীমান্ত পাহারা দিতে পারে। তাই সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার কার্যকর বাস্তবায়ন এবং বিভিন্ন আস্থা বৃদ্ধি করে এমন পদক্ষেপের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। ভারতের গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এটি দুই দেশের মধ্যে প্রথম বৈঠক। ফলে উভয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জন্যই এই আলোচনার গুরুত্ব অনেক বেশি। এই বিষয়ে এনডিটিভিকে এক কর্মকর্তা জানান, এটি একটি দ্বিবার্ষিক প্রক্রিয়া। গত বছরের নবেম্বর মাসে এই আলোচনা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের অনুরোধে তা স্থগিত করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রথম সম্মেলন হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ২ ডিসেম্বর, কলকাতায়। সেই সম্মেলনে তৎকালীন বিডিআরের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল কাজি গোলাম দস্তগীর এবং বিএসএফের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিএসএফের সাবেক মহাপরিচালক অশ্বিনী কুমার। বিজিবি-বিএসএফের সর্বশেষ বৈঠকটি হয়েছিল গত ১৭-২০ ফেব্রুয়ারি, নয়াদিল্লিতে।

এদিকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অতীতেও সীমান্ত বৈঠকে সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে সীমান্ত হত্যার বিষয়টি। কিন্তু এরপরও সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা বন্ধ হয়নি। কিছুদিন পরপরই বিএসএফ বাংলাদেশিদেরকে গুলী করে হত্যা করছে। কখনো কখনো আহত ব্যক্তিকে অথবা নিহত ব্যক্তির লাশ নিয়ে যায় ভারতের অভ্যন্তরে। বিজিবি বিএসএফর মধ্যে পতাকা বৈঠকের পর বিষয়গুলোর মিমাংশা করা হয়। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, গত ১১ বছরে সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে ৩৪৫ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। ২০১৪ সালে ৩২ জন, ২০১৫ সালে ৪৬ জন, ২০১৬ সালে ৩১ জন, ২০১৭ সালে ২৪, ২০১৮ সালে ১৫, ২০১৯ সালে ৪৩, ২০২০ সালে ৪৯, ২০২১ সালে ১৮, ২০২২ সালে ২৩, ২০২৩ সালে ৩১, ২০২৪ সালে ৩০ জন নিহত হন। আর অন্তর্বর্তী সরকারের ১১ মাসে ৩৪ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানায়, আগের বছরগুলোতেও (২০২৩ ও ২০২৪ সালে) এই সংখ্যা যথাক্রমে ৩১ ও ৩০ জন ছিল। বারবার আশ্বাসের পরও এই হত্যাকা- থামেনি। মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেছেন, সীমান্ত হত্যার বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়া উচিত। বিএসএফ বার বার মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। তিনি বলেন, প্রতিবেশী এই দুই দেশের মানুষের মধ্যে নানা ধরনের যোগাযোগ আছে। তারা চোরাচালানের কথা বলে, সেটা সত্য ধরে নিলেও চোরাচালানের শাস্তি তো গুলী করে হত্যা হতে পারে না। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্ত আছে, সেখানে তো তারা এভাবে হত্যা করে না। আর ভারতের ভিতর থেকেইতো গরু আসে। সেই গরু কেন আটকানো হয় না। আসলে এই হত্যার মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশকে চাপে রাখতে চায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি এবং ‘বর্ডার ভায়োলেন্স’ নিয়ে শক্ত অবস্থান না থাকায় সীমান্ত নিয়ে পৃথক আইন থাকার পরও এসব অপ্রয়োজনীয় হত্যাকা- একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ ও ভারতের দায়িত্বশীল আচরণ ছাড়া এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।