বাংলাদেশে ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য পূরণ করতে হলে ৩৫ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ সক্ষমতা স্থাপন করতে হবে। এ জন্য ৩৫.২ বিলিয়ন থেকে ৪২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন। নীতিমালার অসংগতি, জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধে পরিকল্পনার অভাব এবং বিনিয়োগ অনিশ্চয়তার কারণে এই লক্ষ্য অর্জন হুমকিতে পড়তে পারে বলে জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। তবে সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ ও স্মার্ট কৌশল গ্রহণে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সফল রূপান্তর করা সম্ভব বলে জানায় সংস্থাটি।
গতকাল রোববার ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে ২০৪০ সালের মধ্যে ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পুনর্মূল্যায়ন: স্মার্ট লক্ষ্য ও প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের পূর্বাভাস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেন সিপিডির প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট মেহেদী হাসান শামীম।
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় নীতি পরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব লক্ষ্যে বাস্তবতাকে পাশ কাটানো হয়েছে। মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যানে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২৫-এ ২০৪০ সালের মধ্যে এ লক্ষ্য ৩০ শতাংশ। আবার সমন্বিত বিদ্যুৎ জ্বালানি মহাপরিকল্পনায় (আইইপিএমপি) ২০৪০ সালের মধ্যে পরিচ্ছন্ন জ্বালানির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ শতাংশ।
গবেষণায় বলা হয়, সরকারের জ্বালানি পরিকল্পনার অসামঞ্জস্যতার ফলে একদিকে দেশে জীবাশ্ম জ্বালানির উদ্বৃত্ত সক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে লক্ষ্য থাকলেও নবায়নযোগ্য খাতে বিশাল ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সরকারের লক্ষ্য পূরণ করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রয়োজনীয় নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সক্ষমতা হতে হবে ১৮,১৬২ মেগাওয়াট। অথচ বর্তমান পরিকল্পনায় রয়েছে মাত্র ১,৯৬৭ মেগাওয়াট,যা আগামী পাঁচ বছরে ১৬,০০০ মেগাওয়াটেরও বেশি ঘাটতি তৈরি করবে।
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য পূরণে সিপিডির গবেষণায় বেশ কয়েকটি গুরত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রধানত বিনিয়োগ চ্যালেঞ্জের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে সিপিডি। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বাংলাদেশকে ২০৪০ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্য পূরণ করতে মোট ৩৫.২ বিলিয়ন (আমদানি বাদে) থেকে ৪২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন ২০২৫–২০৩৫ সময়কালে, প্রায় ২৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে সৌর শক্তি ১৬.৫ বিলিয়ন ডলার, বায়ু শক্তি ১২.৬ বিলিয়ন ডলার, জলবিদ্যুৎ ৬ বিলিয়ন ডলার, আমদানি ও অন্যান্য ৭.৪ বিলিয়ন ডলার রয়েছে।তবে পরিকল্পনায় নানা জটিলতা বিদ্যমান থাকায় বিনিয়োগকারীরা বিভ্রান্ত হতে পারেন বলে উল্লেখ করেছে সিপিডি।
এদিকে সিপিডি বলছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির মিশ্রণে সৌর বিদ্যুৎই প্রধান, যা বর্তমানে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট থেকে ২০৪০ সালে ১৭,২২৯ মেগাওয়াটে উন্নীত করতে হবে। বায়ু বিদ্যুতের প্রবৃদ্ধি আরও নাটকীয়, যা ৬২ মেগাওয়াট থেকে ১৩,৬২৫ মেগাওয়াটে পৌঁছাতে হবে যা খুবই চ্যালেঞ্জিং।
বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিপিএ) সাবেক প্রেসিডেন্ট ইমরান করিম বলেন, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ মাত্র ২ শতাংশ।কিন্তু ২০৩০ সালের মধ্যে এটিকে ২০ শতাংশে উন্নীত করতে হলে ১২-১৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনঃস্থাপন জরুরি, এক্ষেত্রে বেসরকারি খাত বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশ যদি নীতিগত অস্পষ্টতা ও জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বজায় রাখে, তবে আর্থিক সংকট ও জলবায়ু লক্ষ্যে ব্যর্থতার ঝুঁকি বাড়বে। অন্যদিকে, ঐক্যবদ্ধ ও স্মার্ট কৌশল গ্রহণ করলে বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সফল রূপান্তর করতে পারবে। এখনই সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার সময়।
জ্বালানি রূপান্তরে সিপিডির সুপারিশ
জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সফলভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে উত্তরণে বেশকিছু সুপারিশ করেছে সিপিডি। এসবের মধ্যে রয়েছে-সব জাতীয় নীতিতে সমন্বিতভাবে একটি ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০% নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে।
২০৩০ ও ২০৩৫-এর জন্য স্পষ্ট মাইলফলকসহ একটি জ্বালানি উৎস-ভিত্তিক বাস্তবায়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে জীবাশ্ম বিদ্যুৎকেন্দ্র অবসরের সময়সূচিও থাকে।
নেপাল, ভুটান ও ভারতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি সমৃদ্ধ প্রতিবেশী দেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে স্বল্পমেয়াদি সক্ষমতার ঘাটতি পূরণ এবং আন্তঃসীমান্ত-বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে হবে।
বহুজাতিক উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি, এআইআইবি, বিশ্বব্যাংক) এবং জলবায়ু তহবিলের সঙ্গে কৌশলগতভাবে সম্পৃক্ত হয়ে স্বল্পসুদে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে, প্রকল্প ঝুঁকি কমাতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগে বেসরকারি পুঁজি আকর্ষণ করতে হবে।
গ্রিড অবকাঠামো, বিদ্যুৎ সঞ্চয় প্রযুক্তিতে জরুরি বিনিয়োগ করতে হবে এবং ছাদে সৌরবিদ্যুৎ (রুফটপ সোলার) ও মিনি-গ্রিডের মতো বিকেন্দ্রীকৃত জ্বালানি ব্যবস্থা প্রসার করতে হবে।
অনুষ্ঠানে প্যানেলিস্ট হিসেবে বক্তব্য দেন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ নাভিদ সলিমুল্লাহ, ফাহমিদা খানম, পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশের চেয়ারম্যান রেজওয়ান খান, বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস এসোসিয়েশনস এর সাবেক প্রেসিডেন্ট ইমরান করিম, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মির্জা শওকত আলীসহ প্রমুখ।