আজ ১৪ই জুলাই সোমবার। ২০২৪ সালের এই দিনটি ছিল রোববার। এদিন অফিস আদালতের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে গেলে আবার আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এদিনের কর্মসূচি এবং আন্দোলন এবং স্বৈরাচার হাসিনার একটি মন্তব্য আন্দোলনের গতিতে ঘি ঢালে। আন্দোলনের এই চাঙ্গাভাব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়ে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের মাধ্যমে পরিণতি পায়। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী এদিন রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দেয় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীরা।
রোববার দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিতে যান এবং ৩টায় বের হয়ে আসেন। ১২ জনের একটি প্রতিনিধিদল পুলিশের নিরাপত্তায় বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন। প্রতিনিধিদলে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফ সোহেল, সারজিস আলম, নাহিদ ইসলাম, আব্দুল হান্নান মাসউদ, আসিফ মাহমুদ, রাশিদুল ইসলাম রিফাত, আব্দুল কাদের, মো. মাহিন সরকার, আশিক ও হাসিব আল ইসলাম। এ ছাড়াও ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজের দুই নারী প্রতিনিধি সুমাইয়া জাহান ও মেহের”ন নেসা।রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া স্মারকলিপিতে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা। এ সময়ের মধ্যে সরকার যদি কোনো সিদ্ধান্তে না যায় তাহলে আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবে কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এর আগে দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে মিছিল বের করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। শাহবাগ ও মৎস্য ভবন হয়ে এগিয়ে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মিছিলটি শিক্ষা অধিকার চত্বর ও জিরো পয়েন্টে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে গুলীস্তান শপিং কমপ্লেক্সের সামনের সড়কে অবস্থান নেয়। এতে গুলীস্তান এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বেলা আড়াইটার দিকে এই অবস্থান থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মের ১২ জনের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে যায়। বেলা তিনটার দিকে তারা বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে আসে। পরে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের সামনে এসে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ১২ জনের একটি দল বঙ্গভবনে গিয়ে স্মারকলিপি দিয়েছি। মহামান্য রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের হাতে স্মারকলিপিটি দিয়ে এসেছি। তিনি (সামরিক সচিব) নিশ্চিত করেছেন যে স্মারকলিপিটি দ্রুতই রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছে দেবেন।
সারজিস আলম বলেন, স্মারকলিপিতে আমরা সরকারি চাকরিতে সংবিধান অনুযায়ী শুধু অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য সব গ্রেডে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রেখে সংসদে আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে থেকে ছাত্রসমাজের প্রাণের দাবিটি অতিসত্বর বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবেন বলে আমরা আশা করি।
বঙ্গভবন থেকে ফিরে এসে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘কঠোর কর্মসূচির মাধ্যমে জনদুর্ভোগ তৈরি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে আমরা এখনো কোনো আশ্বাস পাচ্ছি না। সরকারের কী উদ্দেশ্য, তা আমরা বুঝতে পারছি না। সব গ্রেডে কোটা সংস্কারের এখতিয়ার নির্বাহী বিভাগ ও সরকারেরই। আমরা চাইছি, সংসদের মাধ্যমে আইন করে যথাযথভাবে বিষয়টি বিধিবদ্ধ করার জন্য। তিনি বলেন, সবগুলো দরজায় গেলেও আমাদের ফেরানো হচ্ছে, তারপর আবার বলা হচ্ছে যে আমরা বারবার দাবি পরিবর্তন করছি। সরকার প্রথমেই এখানে হস্তক্ষেপ করলে আমাদের এত বক্তব্য দিতে হতো না। আজ আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে এসেছি। সরকারের কাছ থেকে যেহেতু আমরা কোনো আশ্বাস পাচ্ছি না, আমরা চাইছি রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে তিনি হস্তক্ষেপ করে আমাদের এক দফা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইন পাস করতে ভূমিকা রাখবেন এবং প্রয়োজনে জরুরি অধিবেশন আহ্বান করবেন।
নাহিদ ইসলাম বলেন, স্মারকলিপিতে আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ২৪ ঘণ্টার একটি সুপারিশ করেছি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদের অধিবেশন ডেকে আমাদের এক দফা দাবি বাস্তবায়নে আইন পাসের জন্য কার্যকর ব্যবসথা নেওয়া হোক অথবা অধিবেশন আহ্বান করা হোক। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা এই দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখতে চাই। আমাদের দমন করার পরিকল্পনা হচ্ছে। কিন্তু আজ আমরা প্রমাণ করে দিয়েছি যে আমাদের মিছিল থামানো যায়নি।
তিনি বলেন, আমরা জানানোর চেষ্টা করছি যে চাইলে আমরা ১০-২০ হাজার মানুষের জমায়েত করতে পারি। কিন্তু আমরা চাইছি না জনদুর্ভোগের কর্মসূচি করতে আমাদের বাধ্য করা হোক। আমরা দাবির বিষয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দৃশ্যমান পদক্ষেপ চাইছি। আমরা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করব যে সরকার, মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে কী ধরনের বক্তব্য বা পদক্ষেপ আসছে। এরপর আমরা আমাদের পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা ঠিক করব। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার বিষয়ে নাহিদ বলেন, ‘আমরা বলেছিলাম, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় হওয়া অজ্ঞাতনামা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। এটি আমরা আরও ২৪ ঘণ্টা বাড়িয়ে দিচ্ছি এর মধ্যে মামলা প্রত্যাহার করা না হলে আমাদের কর্মসূচি কঠোরতর হবে। নাহিদের বক্তব্যের পর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) তাঁতীবাজার হয়ে মিছিল নিয়ে চলে যায়। অন্য অংশটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলে যায়।
আগের দিন শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি (সমস্যা) সমাধানের বিকল্প কখনোই দাবিয়ে রাখা নয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাজনৈতিক শক্তি ও পুলিশ ব্যবহার করে আমাদের যৌক্তিক আন্দোলনকে দমনের চেষ্টা হচ্ছে। আমাদের চলমান বাংলা ব্লকেড কর্মসূচিকে জনভোগান্তির কারণ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে। আমরা বলতে চাই, যদি প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারেন, তাহলে একটি সন্তানবিবর্জিত পৃথিবী হবে। সুতরাং সুন্দর পৃথিবীর জন্য সাময়িক যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। তিনি বলেন, রোববারের কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজ থাকবে। অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজ নিজ পদযাত্রা নিয়ে একই দাবিতে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেবে।
আরেক সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সরকার আমাদের যৌক্তিক আন্দোলনকে দমনের পরিকল্পনা করছে। আমরা যৌক্তিক দাবি জানিয়ে সরকারের করণীয় সম্পর্কে বলে আসছি। তারা আমাদের দাবি পূরণে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারত। কিন্তু তারা তা না করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে দমনের পরিকল্পনা করছে। তবে এ ধরনের কিছু করে থাকলে তার দায় সরকারকেই নিতে হবে। তা সরকারের জন্যই বুমেরাং হবে। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি চলবে। ছাত্রলীগ সভাপতির ‘রায়ের পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে গেছে’ এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় নাহিদ ইসলাম বলেন, আন্দোলনের ক্রেডিট নেওয়ার জন্য তারা এগুলো বলছেন। আমাদের আন্দোলনে দিনে দিনে শিক্ষার্থী সমাগম বাড়ছে। সুতরাং সাধারণ শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে গেছে– এই দাবি ভিত্তিহীন। আর যে সংগঠন এমন দাবি করছে, তারা কিন্তু আন্দোলনের শুরুতে ছিল না। যখন আন্দোলন সফলতার দিকে, এগুলো তখন তারা ক্রেডিট নেওয়ার জন্য বা আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে বিতর্কিত করতে এ ধরনের কথা বলছে।
সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ ও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন হামলা করেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় নারী পুলিশ দিয়ে নারী শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা চালানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন গণমাধ্যমের কর্মীদের ওপরও হামলা চালিয়েছে কুমিল্লায়। এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।
১৪ জুলাই সন্ধ্যায় গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বললেন, ‘কোটা বিষয়ে আমার কিছু করার নেই।’ শেখ হাসিনা আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে? একথা বলার পর রাত ১০টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে বিক্ষোভের পর মধ্যরাতে শিক্ষার্থীরা জড়ো হন টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে। জমায়েতে শিক্ষার্থীরা ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’সহ নানা ধরনের স্লোাগান দেন। মিছিল হয় জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও।
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের অবমাননা করা হয়েছে দাবি করে রোববার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। একই সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে হামলা চালায় ছাত্রলীগ।
এদিন মধ্যরাতে মিছিল নিয়ে বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা টিএসসিতে সমবেত হন । ঘণ্টাখানেক পর হলগুলো থেকে মিছিল নিয়ে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। দিবাগত রাত ১২টার দিকে টিএসসিতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী সমবেত হন। বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ উপাচার্যের বাসভবনের সামনে জড়ো হয়ে স্লোগান দেন। আধা ঘণ্টা পর তাঁরা আবার টিএসসিতে চলে যান।
ছাত্র হলগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, শামসুন্নাহার হল ও রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরাও এই বিক্ষোভে যোগ দেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘তুমি কে আমি কে/ রাজাকার, রাজাকার’, ‘মেধা না কোটা/ মেধা মেধা’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।
রাজু ভাস্কর্যের সামনে আসা শিক্ষার্থীরা বলেন, অন্যায্য কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলায় আমাদের অপমান করা হয়েছে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। এটা কেউই করতে পারেন না। এর প্রতিবাদে আমরা এখানে এসেছি। শিক্ষার্থীদের অপমান করার অধিকার কারও নেই। রাত দেড়টা পর্যন্ত কয়েক শ ছাত্রছাত্রী টিএসসিতে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যান। দেড়টার পর ছাত্রীরা নিজ নিজ হলে ফিরে যান। পরে ছাত্ররাও তাঁদের হলে ফিরতে থাকেন।
রাত দ্টুইটার কিছুক্ষণ আগে বুয়েটের কয়েক শ শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসে। টিএসসি ঘুরে তাঁরা মিছিল নিয়ে আবার নিজেদের ক্যাম্পাসে ফিরে যান। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, এটা তাঁদের ব্যানারে কোনো কর্মসূচি নয়৷ শিক্ষার্থীরা নিজেদের জায়গা থেকেই প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এদিকে রোববার রাতেই ছাত্রলীগের তিনজন ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সংগঠন থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখার গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন সম্পাদক মাছুম শাহরিয়ার, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শাখার মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণাবিষয়ক উপসম্পাদক রাতুল আহামেদ ওরফে শ্রাবণ এবং আইন অনুষদ শাখার গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক আশিকুর রহমান ওরফে জিম।
এদিকে রাতে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে বের হওয়া শুরু করলে হলগুলোর ফটকে অবস্থান নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কয়েকটি হলের ফটকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের আটকে রাখেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী টিএসসিতে আসেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’এর সমন্বয়ক রিফাত রশিদ অভিযোগ করেন, বিজয় একাত্তর হলের ফটকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আটকে রেখেছেন, এমন খবর পেয়ে তাঁদের বের করে আনতে গিয়েছিলেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। সেখানে তাঁর ওপর হামলা চালানো হয়। রাত ১২টার পর থেকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এসে মধুর ক্যানটিনে জড়ো হন। রাত দুইটার সময়ও সেখানে সংগঠনটির কয়েকশ নেতাকর্মী ছিলেন। শাহবাগেও ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের এক দল নেতাকর্মীকে অবস্থান নিতে দেখা যায়। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের অবমাননা করা হয়েছে দাবি করে রোববার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। একই সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে হামলা চালায় ছাত্রলীগ।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুম তার দেওয়া বয়ানে বলেন, ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের 'রাজাকার' বলার পর ঐ রাতেই অল্প সময়ের মধ্যে মেয়েরা প্রতিরোধ গড়ে তুলে। আন্দোলনের, আসলে কিছু মোমেন্টাম ছিল পুরো আন্দোলন জুড়ে। ১৪ জুলাই শামসুন্নাহার হলের মেয়েরা দরজা ভেঙ্গে বের হয়ে এসেছিল। শামসুন্নাহার হলের একটা লিগ্যাসি বরাবরই ছিল। আমরা যখন ঐদিন স্মারকলিপি জমা দেই রাষ্ট্রপতির কাছে, সেখান থেকে এসে পরবর্তী দিনের কর্ম পরিকল্পনা করে যে যার হলে ফিরেছি, সময়টা সম্ভবত দশটা পাঁচ কি ছয় হবে। তখন হলে এসে আমি ইন্টারনেট অন করে দেখি যে, ছেলেদের হলে রাজাকার, রাজাকার স্লোগান দেওয়া হয়েছে আর ছাত্রলীগের ছেলেরা কোটা বিরোধী শিক্ষার্থীদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে। হয়তো রাতের বেলা বিদ্যুৎ বন্ধ করে তাদের ওপরে হামলা করা হতে পারে। যখন এই নিউজটা আমি পাই। আমি নাহিদ ইসলাম ভাইকে নক করি। ভাইকে বলি যে, ‘ভাই এই তো অবস্থা। এখন কি করবেন ? আপনি যদি বলেন, আমি মেয়েদের নিয়ে বের হতে পারি।’ তখন ভাই বলেছে, ‘দেখো যদি বের হতে পারো, বের হও।’ অদ্ভুত করার মতো যে বিষয়টা ছিল তা হলো, সব মিলিয়ে আমাদের বের হতে পনের মিনিট সময় লাগেনি। আমাদের মেয়েদের একটা গ্রুপ ছিল। সেখানে প্রস্তাবনা উঠানোর সাথে সাথেই অলমোস্ট সবগুলো হল তৈরি হয়ে যায় যে, তারা বের হতে পারবে।
তিনি বলেন, ১৪ তারিখে আমাদের হলের মধ্যে এই পরিস্থিতি দেখে আমাদের শিক্ষকরাও বেশি একটা বাধা দেওয়ার সাহস পায়নি। তারা আমাদের হাতে দরজার চাবি তুলে দেন। তারপর রোকেয়া হল আর শামসুন্নাহার হল বের হয়। তারপর সুফিয়া কামাল হল যোগ দেয়। আর বঙ্গমাতা, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী- এই দুইটা হলের মেয়েরা নীলক্ষেত পার হয়ে ঐ পাশে থাকে। আর নীলক্ষেত মোড়টাতে তখন ছাত্রলীগরা জমায়েত হয়েছিল। নীলক্ষেত মোড়, শাহবাগ মোড় আর এদিকে শহীদ মিনার থেকে জগন্নাথ হলের মাঝের গলি- ওই তিনটা মোড়ে ছাত্রলীগরা জমা হয়েছিল। তখন আমরা ওখান থেকে এসে রাজুতে অবস্থান করি। সেখানে আমরা পাঁচশ’ মেয়ে ছিলাম। এ সময় রাজুতে তখন মাত্র দশ বারোজন ছেলে ছিল। তারমধ্যে নাহিদ ভাই, আখতার ভাই, আসিফ ভাই, হান্নান মাসুদ ছিল। পরে মাহফুজ ভাইও আসে।
আমরা তখন রাজু ভাস্কর্য থেকে একটা মিছিল নিয়ে ভিসি চত্বরে যাই। ছেলেরা যাতে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারে সেজন্য আমরা স্লোগান দিতে থাকি। অবস্থান কর্মসূচি করতে থাকি। তখন ছেলেরাও হল থেকে বের হয়ে এসে আমাদের সাথে যোগ দেয়। পুরো মিছিলটা নিয়ে আমরা আবার রাজুতে ফেরত আসি। রাজুতে আমরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করি। আমাদের কাছে খবর আসে একসাথে পাঁচটা মিনি ট্রাক চারুকলা পার হয়ে এসে নেমেছে। আমরা খবর পাই মিনি ট্রাকে থাকা অজ্ঞাতদের ছাত্রলীগের হলগুলোতে লুকিয়ে রাখা হয় পরের দিন দুপুরে আক্রমণের উদ্দেশ্যে। তবে উদ্দেশ্য ছিল ১৪ তারিখ রাতেই আক্রমণ করার কিন্তু সেদিন এতো উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্ত ছিল এবং সবাই এত জোটবদ্ধ ছিল যে কারো উপর হামলা করার কোন উপায় ছিল না। তবুও সেদিন দফায় দফায় হামলা করার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু আমরা সবাই মিলে তা প্রতিহত করি।
সবচাইতে ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে ১৪ তারিখ রাতে আমার শামসুন্নাহার হলের একজনও হলে ছিল না। এটা কীভাবে বলতে পারছি, যেহেতু আমরা মেয়েদের হলে ঢুকানোর ব্যাপারটা সমন্বয় করছিলাম, আমি আর আশরেফা সবার আগে হলে ঢুকি, তখন আমরা কোন মেয়েকে হলে দেখতে পাইনি। সবাই আমাদের সাথে বের হয়েছিল। এই বিষয়গুলো খুব ইন্সপায়ারিং। সবচাইতে বেশি অদ্ভুত বিষয় ছিল, যারা জীবনে কোনো দিন রাস্তায় নামেনি, পড়ার টেবিল থেকে লাইব্রেরি আর ক্লাসর”মের বাইরে যাদের জীবনে অন্য কিছু ছিল না, তারাও যেভাবে নাগরিক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে নেমে এসেছিল তা খুবই চমকপ্রদ ছিল। আর এটাই জুলাই আন্দোলনকে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের অন্যান্য আন্দোলন থেকে পার্থক্য করে।
ঘটনার পর সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফোরজি নেটওয়ার্ক বন্ধ করতে অপারেটরদের নির্দেশ প্রদান করে। এদিকে, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হামলায় ১৩ আন্দোলনকারী আহত হন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা।
১৪ জুলাই সকাল ১০টায় কান্দিরপাড় পূবালী চত্বরে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। অপরদিকে একইদিন বেলা ১১টায় বিকল্প স্থান হিসেবে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লকেড কর্মসূচিতে’ হামলার প্রতিবাদে পুলিশ লাইন এলাকায় কর্মসূচি পালন করে। কর্মসূচিতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত হয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, কুমিল্লা সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মাথায় বাংলাদেশের পতাকা, হাতে বিভিন্ন প্লেকার্ড ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানার শোভা পায়। তারা এদিন দুপুর ১টায় কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেয়।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা পুলিশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন শেষে সুধী সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে সে সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, আমি মনে করি, তাদের একটু অপেক্ষা করা উচিত; আন্দোলন থামানো উচিত। কারণ, পৃথিবীর সব জায়গায় কোটা রয়েছে। সব দেশেই কিছু অনগ্রসর জায়গা থাকে, যেমন– আমাদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটা রয়েছে। সংবিধানেও সেটি বলা আছে। এটি বাতিল করে দিলে তারা কোনো দিন সমাজের মূল স্রোতে আসতে পারবে না। আমরা মনে করছি, সবাই যেন একসঙ্গে চলতে পারে।
একই দিন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ ওরফে ডিবি হারুন বলেন, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে না গিয়ে বিভিন্ন সড়কে বসে সাধারণ মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। অনেক জায়গায় গাড়িতে হাত দিচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলাও হয়েছে। কেউ যদি মনে করে, আদালত মানবে না, পুলিশের কথা মানবে না; তাহলে আমাদের করার কী আছে ? আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে ক্ষমতা, আমরা সেটাই করব। আন্দোলনরতরা যদি জানমালের ক্ষতি করে, সড়ক অবরোধ করে এবং মানুষের স্বাভাবিক চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়, তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে যৌক্তিক কাজ, সেটাই করা হবে। নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আন্দোলনে অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে কিনা, ঘটনাটি অন্যদিকে ধাবিত করার চেষ্টা চলছে কিনা এসব নিয়ে ডিবির টিম ও পুলিশ কাজ করছে। কেউ যদি হাইকোর্টের নির্দেশনা না মেনে আন্দোলনের নামে সড়কে নেমে অবরোধ করে গাড়িতে হামলা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে, তবে আমরা ধরে নিতে পারি অনুপ্রবেশকারীরাই এসব কাজ করছে।
কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, আমরা প্রত্যাশা করছি অবিলম্বে ক্লাস-পরীক্ষা চালু হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে ফিরেছেন। তারাও ক্লাস-পরীক্ষা অব্যাহত রাখবেন। স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত করতে চাইলে আমাদের সুস্পষ্ট হুঁশিয়ারি থাকবে। সাদ্দাম হোসেন বলেন, আপিল বিভাগ স্থিতাবস্থা দেওয়ার পর ২০১৮ সালে পরিপত্র পুনর্বহাল হওয়ায় সন্তোষ জানিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে গেছে। তাদের অভিনন্দন জানাই। কিন্তু পেশাদার আন্দোলনকারীরা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য রাজপথে রয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালসহ সাত দফা দাবিতে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। সংগঠনের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক আল মামুনের সঞ্চালনায় কর্মসূচিতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ ক ম জামাল উদ্দিন, প্রজন্ম ৭১-এর সভাপতি আজিজুর রহমান প্রমুখ।