প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতি সংখ্যালঘুর সরকার প্রতিষ্ঠা করে, এই পদ্ধতিতে মোট ভোটের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ভোট পাওয়া ব্যক্তি বা দল নির্বাচিত হয়ে থাকে। অবশিষ্ট ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ভোটারের ভোটের মূল্যায়ন হয় না। কিন্তু প্রোপরশনেট রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে সব ভোটারের ভোটের মূল্যায়ন করা হয়। এতে সব ভোটারের মতের প্রতিফলন ঘটে। সংসদে কারা কারা প্রতিনিধিত্ব করবে তা দল ঠিক করে বলে কেন্দ্রে কেন্দ্রে পেশী শক্তির প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যাবে।

গতকাল রোববার ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম (এনডিএফ) আয়োজিত ‘পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি’ শীর্ষক সেমিনারে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের পক্ষে বক্তারা তাদের মতামত তুলে ধরেন। এনডিএফ’র সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো: নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে বক্তব্য রাখেন নয়া দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি মো: শহীদুল ইসলাম, সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মো: সাইফুর রহমান, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এনডিএফ সভাপতি ডা. মো: আতিয়ার রহমান, বরিশাল এনডিএফ সভাপতি ডা. আলতাফ হোসেন, ঢাকা-১৭ আসনের জামায়াত প্রার্থী ডা. এসএম খালিদুজ্জামান। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এনডিএফ জেনোরেল সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হোসেন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এনডিএফ’র সিনিয়র সহসভাপতি ও ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. সাজিদ আব্দুল খালেক। উপস্থাপনা করেন এনডিএফ’র জয়েন্ট সেক্রেটারি ডা. রুহুল কুদ্দুস বিপ্লব।

মাসুর রহমান খলিলী বলেন, জনগণের ‘অভিপ্রায়’ প্রকাশিত হয় বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানে। ২০২৪ সালের ৩৬ দিনের ঘটনা ছিল জনগণের অভিপ্রায়। বর্তমান সরকারের বিধান সংবিধানে নেই কিন্তু এতে জনগণের অভিপ্রায়ের প্রকাশ ঘটেছে। ৩৬ জুলাই ফ্যাসিবাদের পতনে জনগণের চুড়ান্ত অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়েছে। জনগণের অভিপ্রায়ই চুড়ান্ত, এটা বাংলাদেশের সংবিধানের মূল এ্যাসেন্স (বৈশিষ্ট্য)। জনগণের অভিপ্রায়কে সম্মান করে সংবিধান পরিবর্তন করা যায়। ১৯৭৫ সালের পরের ঘটনাক্রম জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতিফলন ঘটে। জনগণের অভিপ্রায়কে সম্মান করে সংবিধানে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের বিধান সংযোজন করা যায়। তিনি বলেন, প্রচলিত পদ্ধতির নির্বাচনে ফ্যাসিবাদ ফিরে আসে। নিকট অতীতে ২০০৮ সালে ডিসেম্বরের নির্বাচন দৃশ্যত: সুষ্ঠু হলেও এটা ছিল একটি কারসাজীর নির্বাচন। বাইরে সবকিছু ঠিক থাকলেও ভেতরে ভেতরে কারসাজী করে ফ্যাসিবাদ কায়েমে ভূমিকা রেখেছে। তিনি বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি জনগণের অভিপ্রায়ের দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। ফ্যাসিবাদের ফিরে আসা ঠেকাতে চাইলে জণগনের অভিপ্রায়কে সম্মান করতে হবে। এ বিষয়ে একটি গণভোট আয়োজন করে জনগণের মত নেয়া যেতে পারে। মাসুমুর রহমান খলিলী বলেন, পিআর পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ রয়েছে। অন্তত: এই বিরোধ মাঝামাঝি পর্যায়ে নিয়ে আসতে না পারলে ভবিষ্যতে জাতির কল্যাণ নাও হতে পারে।

ডিইউজে সভাপতি মো: শহিদুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার কারণে জুলাই বিপ্লবের অভিপ্রায় বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যে পদ্ধতির নির্বাচনে হাসিনা ফ্যাসিবাদী দানবে পরিণত হয়েছে সেই পদ্ধতির নির্বাচন বহাল থাকলে ভবিষ্যতে আবারো ফ্যাসিবাদ কায়েম হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবারো গুম, খুন, গণহত্যা ফিরে আসতে পারে।

এডভোকেট মো: সাইফুর রহমান বলেন, বর্তমান সরকার বিপ্লবের মাধ্যমে এসেছে। কিন্তু এই সরকারের বিপ্লবীদের দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও তাদের থার্ড পার্টি করে দেয়া হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের স্মার্ট ভোট গ্রহণ পদ্ধতি পিআর পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে বিজ্ঞ, সৎ ব্যক্তিদের সংসদে আসার সুযোগ ঘটে। অনাস্থা ভোট করে সংসদ ভ্গাংতে পারবে না বলে, এই পদ্ধতির নির্বাচনের সরকার স্থায়ী হয়।

ডা. মো: আতিয়ার রহমান বলেন, সরকারে বা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব না থাকলে ফ্যাসিস্ট কায়েম হবেই। পিআর পদ্ধতি ফ্যাসিস্ট হওয়া ঠেকাতে পারে।

মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হোসেন বলেন, প্রচলিত পদ্ধতিতে কোনো দল ৫১ শতাংশ ভোট পেলেই সরকার গঠন করতে পারে। কিন্তু বাকী ৪৯ শতাংশ ভোটকে মূল্য দেয়া হয় না। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে সেই সংসদে তত শতাংশ আসন পাবে। এতে সরকার স্থিতিশীল হয়, শক্তিশালী বিরোধী দলও হয়। পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে ব্যক্তির একার জেতার প্রশ্ন আসবে না, এই পদ্ধতিতে জিতবে দল। পিআর পদ্ধতিতে রাজনৈতিক হতাশা ও লেজুড় বৃত্তি কমে যায়। পৃথিবীর ১০০টির মতো দেশে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন হয়ে থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালেও আছে।