তরুণ রাজনীতিকদের মধ্যে মতাদর্শভিত্তিক সংলাপ এবং গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদার করার লক্ষ্যে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ-সিজিএস’র কর্মশালায় দেশের রাজনীতিবিদরা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য বা আকাক্সক্ষা কেবল একজন ফ্যাসিস্ট নেতাকে বিদায় এবং আরেক নেতাকে ক্ষমতায় বসানো নয়, বরং ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাকে সংস্কার করে মানুষের ভোটের অধিকার, ন্যায় বিচার এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার হাতে যে পরিমাণ ক্ষমতা ছিল, তার মূল কারণ ছিল সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ ও ফ্লোর ক্রসিং-এর বিধান। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলে সংসদ কখনোই প্রকৃত অর্থে মুক্ত ছিল না। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে তা বাস্তবায়ন জরুরি।
গতকাল শনিবার সেন্টার ফর গভার্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) ফ্রেডরিখ এবার্ট স্টিফটুং (এফইএস)-এর সহযোগিতায় ইতিমধ্যেই পলিটিক্স ল্যাব শীর্ষক বিভিন্ন বিষয়ে চারটি ধারাবাহিক কর্মশালার আয়োজন করেছে। এই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে সিজিএস একটি জন-সংলাপের আয়োজন করেছে। সংলাপে আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, এফইএস বাংলাদেশ এর রেসিডেন্ট রিপ্রেসেন্টেটিভ ফিলিক্স গ্রাদেস, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা, সেন্টার ফর গভারন্যান্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক পারভেজ করিম আব্বাসী। এছাড়াও এই সংলাপে অংশগ্রহণ করেন দেশের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিরা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিজিএস-এর প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান।
জিল্লুর রহমান আশা করেন উপস্থিত তরুণেরা ‘পলিটিক্স ল্যাব’-এর মাধ্যমে যে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা ভবিষ্যতে কাজে লাগিয়ে একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। আমরা বাংলাদেশ কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি সিস্টেম অনুসরণ করি এবং আমাদের জাতীয় সংসদ ভবনের মতো স্থাপত্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই। লক্ষ্য করা যাচ্ছে স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে অনেক দেশ বাংলাদেশের থেকে অনেক এগিয়ে গেছে, যা হতাশাজনক। জিল্লুর রহমান বলেন, আমাদের উচিত জনগণের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া। এই মৌলিক গণতান্ত্রিক দায়িত্ব আমরা এখনো পালন করতে পারিনি, অথচ সুস্থ রাজনৈতিক বিকাশের জন্য সেটিই সবচেয়ে জরুরি।
ফিলিক্স গ্রাদেস বলেন, এফইএসের রাজনৈতিক জ্ঞান বিনিময়ের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বিশ্বজুড়ে ‘জেন জি’-এর নেতৃত্বে আন্দোলন, শ্রীলঙ্কা থেকে মাদাগাস্কার পর্যন্ত, যেখানে সরকার পতনের পর নতুন প্রজন্ম সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে। এটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে, বহু গভীর সমস্যা রয়েছে, যা রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সংলাপ এবং গণতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হওয়ার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। শুধুমাত্র নির্বাচনই গণতন্ত্র রক্ষার একমাত্র উপায় নয়। নাগরিক সমাজ, তরুণ প্রজন্ম এবং গবেষণা খাতকে শক্তিশালী করাই সুশাসনের পথে এগিয়ে যাওয়ার মূল উপায় হতে পারে। তিনি আশা করেন তরুণ রাজনীতিকরা ‘পলিটিক্স ল্যাব’-এর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাজের কল্যাণে কাজ করবে।
জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, যদি সবাই ফ্যাসিবাদমুক্ত দেশ চায়, তাহলে আলোচনার মাধ্যমে এবং ভিন্নমতকে সম্মান জানিয়ে ঐকমত্যের পথেই এগোতে হবে। জাতীয় নির্বাচনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, এবং সৃজনশীল চিন্তা ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের মাধ্যমেই রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব, ।
পারভেজ করিম আব্বাসী বলেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানেরও মূল দাবি ছিল সুশাসনের প্রতিষ্ঠা। দেশে ৫১ শতাংশ নারী থাকা সত্ত্বেও অভ্যুত্থানের পর আমরা তাঁদের অধিকার সুরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছি। অথচ নারীরা আমাদের অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তি, এবং অভ্যুত্থানেও তাঁদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। দেশের সমস্যার মূল কারণ হলো আমরা এখনো সহনশীলতার চর্চা করতে শিখিনি। সেই সহনশীলতা, রাজনৈতিক শিক্ষা এবং দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে বহুত্ববাদের অনুশীলনই ‘পলিটিক্স ল্যাব’-এর মূল উদ্দেশ্য।
মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, যারা রাজনীতিকে ঘৃণা করেন, তারা নিজের কাছে প্রশ্ন করবেন রাজনীতি ছাড়া কি চলা সম্ভব? বাস্তবতা হলো, মূলধারার দুটি দল ও এনসিপি এখন বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে, যেখানে বিএনপি যেন সরকারে এবং বাকি দুটি দল বিরোধী দল হিসেবে অবস্থান করছে। কিন্তু এই দুই দল ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন আর দেখা যায় না। তিনি আরও বলেন, নির্বাহী বিভাগের এককচ্ছত্র ক্ষমতা কমাতে হবে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে যদি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো না থাকত, তাহলে রাজনীতি আরও উন্নত হতো। বিএনপি যদি কিছুটা নমনীয় হয়ে নিজের অবস্থান থেকে সরে এসে সমঝোতার পথে আসতে পারত, তাহলে গণভোট বা জুলাই সনদ নিয়ে এত বিতর্ক থাকত না।
নুরুল হক নূর বলেন, আমার কাছে এখনো বিস্ময়কর লাগে যে, দেশের চারটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির এমন ভূমিধ্বস জয় পেয়েছে, যেখানে আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা তরুণরা পরাজিত হয়েছে। শুধু আন্দোলনের নেতৃত্ব নয়, সেখানে ছাত্রদলসহ আরও রাজনৈতিক সংগঠন সক্রিয় ছিল। এই অপ্রত্যাশিত ফলাফল তাকে হতাশ ও উদ্বিগ্ন করে। তিনি জানান, যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। এটি আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, একটি নির্বাচিত সংসদ গঠন করতে হবে, এবং সেই সংসদই সিদ্ধান্ত নেবে সংস্কারগুলো কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, এই সরকার নয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাকে একত্রে ধারণ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
এনসিপি’র তাসনিম জারা বলেন, জুলাই সনদের পর এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, পরিবর্তন কীভাবে আনা যায়, যেখানে অনেক বিষয় এখনো স্পষ্ট নয়। দেশের অবস্থান এখনো এতটাই দুর্বল যে আন্দোলন ছাড়া কোনো দাবি আদায় করা যায় না, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। তাই যেকোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কৌশলগতভাবে এগোতে হবে। তিনি মনে করেন, আগামী দিনের রাজনীতি গড়তে তরুণদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে, যাতে যারা দেশের জন্য কাজ করতে চায় তারা একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ পায়। পাশাপাশি, প্রবাসীরা অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করাও এখন অত্যন্ত জরুরি, যা বিভিন্ন কারণে এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।