সম্প্রতি গঠিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জাতির আশা- আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বিরোধী অনেক প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করায় জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে বলে মন্তব্য করেছেন নারী অধিকার আন্দোলনের সভানেত্রী মমতাজ মান্নান।

তিনি বলেন, নারী সংস্কার কমিশন মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কারসহ আরো কতিপয় সুপারিশ করেছে, যা নিয়ে দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে এই সংস্কারের আওতায় যাদের জীবন সরাসরি প্রভাবিত হবে, দেশের সেই সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম নারীদের প্রতিনিধিত্ব এই কমিশনে নেই কেন?

নারী অধিকার আন্দোলন

আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিতর্কিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবিতে নারী অধিকার আন্দোলন আয়োজিত এক মানববন্ধনে তিনি এসব কথা বলেন।

মমতাজ মান্নান বলেন, বিয়ে, তালাকসহ অন্যান্য বিষয় পবিত্র কোরআন দ্বারা নির্ধারিত। অথচ রাষ্ট্রের গঠিত নারী সংস্কার কমিশনে এমন কোনো নারীর উপস্থিতি নেই- যিনি ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত। কমিশনের সেক্যুলার নারীদের বক্তব্যে প্রতীয়মান হয়, তারা এর প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেননি। তাদের সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে পারিবারিক কাঠামো হুমকির মুখে পড়বে। এতে রাষ্ট্র ও সমাজ বিপর্যস্ত হবে ।

নারী অধিকার আন্দোলন-2

ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির প্রভাষক ইঞ্জিনিয়ার মারদিয়া মমতাজ বলেন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ইসলামপন্থীদের কাছ থেকে কোনো মতামত বা সুপারিশ নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি।

আলেম ওলামাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ইসলামের প্রত্যেকটি বিধানের যে অ্যাপ্লিকেশনগুলো আমরা এড়িয়ে যাবো, সেই জায়গাগুলোতে শয়তান তার পলিসিগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে।

নারী অধিকার আন্দোলন-3

তিনি বলেন, পৈতৃক সম্পত্তিতে ভাইয়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ সম্পত্তি বোন পাওয়ার কথা, বাংলাদেশে তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। জেনারেশনের পর জেনারেশন নারীরা বঞ্চিত হয়ে আসছে। আমরা এটা নিয়ে কথা বলছি না। একটি সময়ে নারীরা কনভিন্সড হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মহিলা আলেমরা কথা বলেন না, পুরুষ আলেমরাও কথা বলেন না। যার কারণে বাংলাদেশের নারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা সমাজে সহজ হয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, ধর্মহীনতার ও ধর্মবিমুখতার প্রচলন এবং অভিন্ন নারীবাদী আইনের নামে যে ধর্মকে অস্বীকার করার আহ্বান, তাতে নারীদের ও আমাদের পরিবারগুলোকে একটি বস্তু হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আমাদের পরিবার ও সম্পর্কগুলোকে ভাবা হচ্ছে- এগুলো পয়সা দিয়ে কেনা যায়। আইন দিয়ে বদলানো যায়। এ বিষয়ে মুসলিম হিসেবে দাবি করা নারীদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান এই নারী নেত্রী।

অধ্যাপক ডা. আফরোজা বুলবুল বলেন, নারীদের ভরণপোষনের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। নারীদের পতিতা বলতে চাইনা আমরা। পতিতাদের কেউ সম্মান দেখায় না। শরীর আমার সিন্ধান্ত আমার -এটি নিকৃষ্ট মানসিকতা। নারী ও পুরুষ আলাদা ধরনের সৃষ্টি। সৃষ্টিগত যে আইনকানুন আছে—তা লঙ্ঘন করা যাবে না। আমরা নারী-পুরুষের কোনো সাংঘর্ষিক সমাজ চাই না। আমরা৷ ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যপন্থার সমাজ বিনির্মাণ করতে চাই।

মানব বন্ধনে বেশ কয়েকটি দাবি তুলে ধরেন নারী অধিকার আন্দোলনের সভানেত্রী মমতাজ মাননান

দফাসমূহ-

১. একপেশে নারী সংস্কার কমিশন বিলুপ্ত করতে হবে। সকল অংশীজনের সমন্বয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নতুন কমিশন গঠন করতে হবে।

২. কমিশনের সুপারিশে নারী ও পুরুষের বৈষম্যের কারণ হিসেবে ধর্মকে দায়ী করা হয়েছে। এই ধরনের পক্ষপাতমূলক চিন্তা পরিহার করতে হবে।

৩. পতিতাবৃত্তিকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত না করে এটিকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এই পেশা নারীর জন্য চরম অবমাননাকর। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সাথেও সাংঘর্ষিক—তাই এই সুপারিশ বাতিল করতে হবে।

৪. কমিশন সবক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমতার সুপারিশ করেছে। এটি বাতিল করে ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ যে নীতি—সমতা ও ন্যায্যতা ক্ষেত্রবিশেষে তা বহাল রাখতে হবে।

৫. জাতিসংঘের নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্যবিলোপ সনদের দুটি ধারা কমিশন প্রত্যাহার করার যে সুপারিশ করেছে—তা বাতিল করে ধারা দুটি বহাল রাখতে হবে।

৬. ইসলামের উত্তরাধিকার আইন বলবৎ থাকতে হবে।

৭. কমিশনের সুপারিশে সমতার অধিকার বিষয়ে তালাকের নীতিতে ভরণপোষণের দাবি, ধর্ষণের শাস্তি, ম্যারিটাল রেপসহ, পতিতাবৃত্তিকে স্বীকৃতি—এমন সব হাস্যকর দাবি বাতিল করতে হবে।

৮. কমিশন বহুবিবাহ বিলোপ করার প্রস্তাব করেছে। ইসলামে বহুবিবাহ অবাধ নয়, অত্যন্ত শর্তসাপেক্ষ। তাই কমিশনের এই সুপারিশ অপ্রয়োজনীয় বলে বাতিলযোগ্য।

৯. কমিশন বিয়ে বিচ্ছেদের সময় মোহরানা পরিশোধের সুপারিশ করেছে। ইসলাম আগেই এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। স্বামী-স্ত্রী মিলনের আগেই তা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। সুতরাং, এই সুপারিশ অপ্রয়োজনীয়।

১০. নারীদের পণ্য হিসেবে ব্যবহার না করা। তীব্র প্রতিবাদ জানায় নারী অধিকার আন্দোলন।

মানবন্ধনে আরও বক্তব্য দেন, নারী অধিকার আন্দোলনের সহ সভানেত্রী ও লালমাটিয়া মহিলা কলেজের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক আফিফা মুশতারী, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান (অব.) অধ্যাপক ডা.নাঈমা মোয়াজ্জেম,

আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টর অব রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন্স দ্য গামবিয়ার অধ্যাপক ড.আফরোজা বুলবুল, নারী অধিকার আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক ও ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. শারমিন ইসলাম, হিউম্যান রাইটসের ডেপুটি ডিরেক্টর ও নারী অধিকার আন্দোলনের সহ-সভানেত্রী সুফিয়া খাতুন এবং এডভোকেট ফাতেমা ইয়াসমিন মহুয়া। :

মানববন্ধনের সঞ্চালনা করেন মানারাত ইন্টান্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ড.সাবিহা সুলতানা।