# বিতর্কিত টাইগার আইটির কাছ থেকে সরাতে পারছে না ইসি
# ঝুঁকিতে ১২ কোটির বেশি নাগরিকের ডাটাবেজ
দেশের মূল্যবান সম্পদ এনআইডির তথ্যভান্ডার বা ডাটাবেজ বিতর্কিত টাইগার আইটির কাছেই রয়ে গেছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরও বিতর্কিত এই প্রতিষ্ঠানের কাছে এনআইডির মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় পরিচয়পত্র এনআইডির ডাটাবেজের দায়িত্ব থেকে যাওয়ায় নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। নানা ছলাকলা করে প্রতিষ্ঠানটি নির্বাচন কমিশনকে এর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে ঠিক কি কারণে তা হচ্ছে না তার সন্তোষজনক জবাব নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রশ্নবিদ্ধ টাইগার আইটির কাছে এনআইডি সার্ভার রেখে দেওয়াটা নিশ্চিত ঝুঁকিপূর্ণ।
পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিতর্কিত ব্যবসায়ী এবং দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারকারী ঋণ খেলাপি বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত প্রশান্তকুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার এবং তার সহযোগিদের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে পার্শ¦বর্তী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে বিক্রি করে দেন স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তথ্য উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়।
এর পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে পিকে হালদারের সহযোগি এবং তাদের আত্মীয় স্বজন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে থাকার সময়। পুরো সিন্ডিকেট মিলে নাগরিকদের মুল্যবান তথ্য পাচার করেছে। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই পিকে হালদারসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা একাধিক পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট বানিয়ে একইসাথে কয়েকটি দেশের নাগরিক হয়েছে। এসব পাসপোর্ট ব্যবহার করে হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর বিদেশে পালিয়েছে। সম্প্রতি এমন একজন দেশের অর্থ লোপাটের সঙ্গে জড়িত পি কে হালদারের ঘনিষ্ট সহযোগী তাজবীর হাসানকে বিমানবন্দর থেকে আটক করে গোয়েন্দারা। তুরস্কসহ আরও একটি দেশের নাগরিকত্ব এবং পাসপোর্ট রয়েেেছ তার।
টাইগার আইটির কাছ থেকে এনআইডির সার্ভার পৃৃথকিকরণের কাজ কতদূর এগিয়েছে, সেই ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব এএসএম হুমায়ুন কবিরকে ফোন করা হলে তার ব্যক্তিগত সহকারী শেখ ফরিদ দৈনিক সংগ্রামকে জানান স্যার দেশের বাইরে আছেন। একইবিভাগের সিস্টেম ম্যানেজার মোহাম্মদ আশরাফ হোসেনও দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে জানান শেখ ফরিদ। এএসএম হুমায়ুন কবিরের পরিবর্তে দায়িত্বে থাকা আরেক অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী নেওয়াজ এবিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানিয়ে দেন।
জানা গেছে, বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি’র কাছ থেকে এনআইডির তথ্যভান্ডার পৃথক করার চেষ্টা চলছে অনেক দিন ধরেই। নানা কারণে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পেরে উঠছে না ইসি। বিগত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের সময় বাংলাদেশের নাগরিকদের সমস্ত তথ্য ভারতের কাছে তুলে দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণেই এখনো রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ডাটাবেজটি।
আওয়ামী লীগ আমলের ১৫ বছর একটি মাফিয়া চক্রের মাধ্যমে অরক্ষিত অবস্থায় পরিচালিত হয় ১২ কোটি ৬১ লাখ নাগরিকের এনআইডি ডাটাবেজ। এ ডাটাবেজ ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাও (‘র’) ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনার সম্মতিতে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও তারিক সিদ্দিক ডাটাবেজটি ‘র’-এর হাতে তুলে দেন।
অভিযোগ আছে, বিতর্কিত ব্যবসায়ী পিকে হালদারের সহযোগি ঋণখেলাপির দায়ে অভিযুক্ত সিদ্দিকুর রহমান তার ভায়রা নির্বাচন কমিশনের এনআইডি সার্ভারের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব (অবসরপ্রাপ্ত) একেএম হুমায়ুন কবিরকে দিয়ে টাইগার আইটির মাধ্যমে এনআইডির ডাটাবেজ ‘র’ হাতে তুলে দেন। সেই হুমায়ুন কবির এখন অবসরে। তার কারণে মূলত টাইগার আইটির কাছ থেকে এনআইডির তথ্য ভান্ডার পৃথক করা যায়নি। এই সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মো. সরওয়ার হোসেন (চাকুরীচ্যুত) তার নির্দেশে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভণর এসকে সূর পিকে হালদারের যাবতীয় ফাইল পাশ করাতেন। ভারতে অবস্থানরত ঋণখেলাপি প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার ও পোশাক কারখানা সিমটেক্সের মালিক পূর্তগালে পলাতক সিদ্দিকুর রহমানের যাবতীয় ফাইল পাশ করতেন।
টাইগার আইটির কর্ণধার জিয়াউর রহমানও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। এই জিয়াউর রহমানের সঙ্গে শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তথ্যভান্ডারকে কাজে লাগিয়ে ঘুস হিসেবে তারিক সিদ্দিক কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে বিশ্বব্যাংকের তদন্তেও উঠে এসেছে। স্মার্টকার্ড প্রকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বিশ্বব্যাংক ২০১৯ সালে তারিক সিদ্দিকের নিয়ন্ত্রণাধীন টাইগার আইটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে। ব্যাপক অভিযোগের পরও শেখ পরিবারের সঙ্গে সখ্য থাকায় টাইগার আইটি সব সময় ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। অতীতে কোনো কর্মকর্তা তথ্যভান্ডারকে সুরক্ষিত করতে চাইলে তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার নজির রয়েছে।
সব শেষ খবর হলো জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) তথ্যভান্ডারের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটির ১৯ কর্মকর্তার পাসপোর্ট জব্দ এবং তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়)। সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে পাসপোর্ট এবং ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব ব্যক্তির বিষয়ে অধিকতর তদন্তেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এর অংশ হিসেবে টাইগার আইটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় নির্বাচন কমিশন। চিঠিতে টাইগার আইটির সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন ১৯ ব্যক্তির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি এবং পাসপোর্ট জব্দ রাখার অনুরোধ করা হয়। তথ্যভান্ডার ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম এবং দায়িত্ব হস্তান্তরসহ নানা বিষয়ে গড়িমসির কারণে টাইগার আইটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়।
এনআইডি অনুবিভাগের ডিজি ও আইডিয়া প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডক্টর সালিম আহমেদ খান দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, আমি বর্তমানে অন্য প্রজেক্টে কাজ করছি। ২০১৩ সালে দায়িত্বে এনআইডি সার্ভার নিয়ে কাজ করার সময় তাদের কাজে বিভিন্ন গ্যাপ পেয়েছিলাম। তখন তারা আমাকে সহযোগিতা করেনি। তবে এটা বলতে পারি টাইগার আইটির কাছে এখনো এনআইডি সার্ভার থাকা নিশ্চিতভাবেই ঝুঁকিপূর্ণ।