গেল শুক্রবার লন্ডনে অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক ঘিরে নানা মহলে প্রশ্ন, আলোচ্য বিষয় নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব এবং ফলাফল ঘিরে সন্দেহ বিরাজ করছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি রাজনীতিক দল বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতির বিষয়ে অসন্তোষ জানিয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে। এছাড়া তারেক রহমান ও ড. ইউনূসের মধ্যকার একান্ত বৈঠকের বিষয়ও জাতির সামনে প্রকাশের দাবি জানানো হয়েছে। তারা বলছেন, আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণে সবাইকে সমান গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রদান করা নৈতিক কর্তব্য। লন্ডন বৈঠকের চরিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবমূল্যায়নের ধারণা জন্ম দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. ইউনুস ও তারেক জিয়ার মধ্যকার আলোচনা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, আলোচনায় উভয় পক্ষই বেশ কিছু শর্ত দিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, দেশের ভোট নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা এবং বিএনপির শীর্ষ নেতার মধ্যকার বৈঠকটি যেভাবে বিদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত হল তাতে মূলত রাজনৈতিক পরাজয় হলো। এছাড়া দুই পক্ষের মধ্যকার ‘সমঝোতা’র বিষয় নিয়েও চলছে আলোচনা। আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামী অভিযোগ করেছে, বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে সরকার যেভাবে ব্রিফিং ও বিবৃতি দিয়ে বৈঠকের বিষয়বস্তু প্রকাশ করেছে তাতে একটি বিশেষ দলের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করেছে। অন্যদিকে নব গঠিত দল এনসিপি বলেছে, ‘জুলাই সনদ’ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পরই নির্বাচন-সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত। দলটি অভিযোগ করেছে, সরকার একটি দলের দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। একই ধরণের অভিযোগ তুলেছে আরও বেশ কয়েকটি দল।
বিএনপির নেতারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনীতিতে টানাপড়েন যেভাবে অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছিল, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকের পর আপাতদৃষ্টিতে তা অনেকটা কেটেছে। ওই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমযান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের মধ্যে অনেক শব্দের ‘মারপ্যাচ’ রয়েছে। তা হলো ‘সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে’ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করা যেতে পারে। তাই ঘোষিত ওই সময়ে নির্বাচন হবে কি না তা নিয়ে এখনও সংশয় রয়ে গেছে। এসব কারণে সামনের সময়টায় ‘রাজনৈতিক মেরুকরণ আরও জটিল’ হয়ে উঠতে পারে। তাই জটিলতা এড়াতে আগেই প্রয়োজনীয় সংস্কার ও বিচারের দৃশ্যমান কার্যক্রম শেষ করে নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, সংলাপের মাধ্যমে সংকট সমাধানের যে ধারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অনুপস্থিত, সেখানে লন্ডনের বৈঠকের মাধ্যমে পরিবর্তনের হাওয়া লাগল। এটি আপাতত পজিটিভ। নির্বাচনের তারিখের ক্ষেত্রে বিএনপি এবং সরকার তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এটিই হলো সবচেয়ে বড় দিক। তবে সবকিছু নির্ভর করছে ভবিষ্যতের কার্যক্রমের উপর।
সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল তার ইউটিউব চ্যানেলে বলেছেন, ড. ইউনূস বলেছিলেন আগামী বছরের এপ্রিলে নির্বাচন দেবেন। আর তারেক রহমান চেয়েছিলেন এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া হোক। কাজেই এ বিরোধ মেটানো দরকার ছিল। এখন যেটি বলা হচ্ছে তাতে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে। মাসুদ কামাল বলেন, এখানে অনেক শব্দের মারপ্যাচ আছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘সংস্কার ও বিচারের পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করতে হবে। বিচার আসলে কার ওপর নির্ভর করছে, বিচার কে করছে? বিচার তো করছে আদালত। আদালতকে কি বিচারের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া যায়? যদি বিচারের অগ্রগতি না হয়, তা হলে কি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে? এই বিষয়গুলো অস্পষ্ট। তাই নির্বাচন হতে পারে ফেব্রুয়ারিতে, তবে এখানে কিছু ‘যদি’ ও কিন্তু রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব দল ও সংগঠনের সম্মতি ও সমর্থন নিয়েই মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছিল। কিন্তু তারা সবসময় নিরপেক্ষ থাকতে পেরেছে বলে মনে হয় না। অনেক ক্ষেত্রে চাপের মুখে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা হলে এবারও কি বিএনপির চাপের কাছে সরকার নতিস্বীকার করল কি না সেই প্রশ্নও উঠছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আবদুল আলীম বলেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের একগুচ্ছ সুপারিশ রয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাইয়ে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণা দেওয়ার কথা রয়েছে। সংস্কারের এসব সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে, পরিবর্তন করে ফেব্রুয়ারির আগে কাজ শেষ করা হবে ইসির জন্য চ্যালেঞ্জিং। এটি করতে হলে ফেব্রুয়ারিতে ভোটের তারিখ সামনে রেখে হালনাগাদ ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা, দল নিবন্ধন, সীমানা নির্ধারণ, পর্যবেক্ষক, গণমাধ্যম নীতিমালা, ভোটকেন্দ্রের তালিকা ও প্রবাসী ভোটারদের পদ্ধতি চূড়ান্ত করে রোডম্যাপ দ্রুত করতে হবে ইসিকে।
এদিকে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠক দেশের রাজনীতিতে কিছু সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এই বৈঠক রাজনীতিতে এক ধরনের অস্বস্তিও তৈরি করেছে বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীম চরমোনাই পীর। দলের সিনিয়র দায়িত্বশীলদের সঙ্গে দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনাকালে তিনি বলেন, বিশেষত দুই পক্ষের প্রতিনিধিসহ বৈঠকের পরে দুই নেতার একান্ত বৈঠক রাজনীতিতে কিছু প্রশ্ন তৈরি করেছে। আগামী রাজনীতির স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য এবং দলগুলোর অস্বস্তি দূর করতে একান্ত বৈঠকের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত জাতির সামনে পরিষ্কার করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি বহুদলীয় রাজনীতি। বিগত ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই দেশের বহুসংখ্যক রাজনৈতিক সংগঠন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অংশ নিয়েছে। আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণে সবাইকে সমান গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রদান করা নৈতিক কর্তব্য। লন্ডন বৈঠকের চরিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবমূল্যায়নের ধারণা জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন আয়োজনের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নানা রকম দাবি থাকা সত্ত্বেও সব উপেক্ষা করে প্রধান উপদেষ্টা ঈদের আগের দিন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে একটা সংক্ষিপ্ত সময়সীমা ঘোষণা করেছিলেন। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে যে সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে- তা একটি একান্ত বৈঠকের পরে পুনর্বিবেচনা করার যৌথ ঘোষণা দেওয়া রাজনীতিতে অস্বস্তি তৈরি করেছে। সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণের স্বার্থেই এই অস্বস্তি দূর করা উচিত। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির বলেন, নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার ও পতিত ফ্যাসিবাদের বিচার নিশ্চিত করার দাবি পুনর্ব্যক্ত করছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। নির্বাচনের ডামাডোলে সংস্কার ও বিচার যাতে আড়াল না হয়, সেদিকে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের ফলপ্রসু বৈঠকে স্বস্তিতে দলটির নেতাকর্মীরা। তবে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত তাদের শঙ্কা থাকবে বলে জানিয়েছেন দলটির অনেক শীর্ষ নেতা। তারা জানান, লন্ডনে দুই শীর্ষ নেতারা বৈঠকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অনেকটাই কমেছে।
লন্ডনের বৈঠক অনেক রাজনৈতিক দলের মনে জ্বালা ধরিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, অনেকেই এটা মেনে নিতে পারছে না।
এদিকে অধ্যাপক ইউনূস এবং তারেক রহমানের ঘণ্টাব্যাপী একান্তে আলোচনায় কোন ধরনের সমঝোতা হয়েছে কিনা তা নিয়ে রাজনীতির মাঠে জল্পনাকল্পনা দেখা দিয়েছে। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে এমন বিষয়টি নাকোচ করা হয়েছে। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে আদালত ও নির্বাচন কমিশনের গেজেট অনুযায়ি শপথ নেওয়ার আন্দোলন থেকে সরে আসা, দুই ছাত্র উপদেষ্টাসহ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে নমনীয় ভূমিকায় থাকার সিদ্ধান্ত রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, একান্ত বৈঠকে রাষ্ট্র পরিচালনা, অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পরামর্শমূলক বক্তব্য, এসব আলোচনা তো হয়েছেই। আমরা ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শকে কাজে লাগানোর আগ্রহ প্রকাশ করি। তারেক রহমানও সেই আলোচনাই করেছেন।