ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান নাসির এনডিসি. পিএসসি, উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে স্বৈরাচার সরকারকে ‘না’ বলেছেন ২০০৯ সালেই। তৎকালীন বিডিআর হত্যাকান্ডের পর তদন্ত কমিটির মেম্বার ছিলেন তিনি। স্বৈরাচার সরকার পারেনি তার কাছ থেকে বিডিআর হত্যাকান্ডের অনৈতিক সুবিধা নিতে। ২০২৪ সালের জুলাই আগস্টের ছাত্রজনতার আন্দোলনে তিনি ছিলেন রাজপথে। সেসব গল্প বলেছেন দৈনিক সংগ্রামকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইবরাহীম খলিল।

দৈনিক সংগ্রাম : আমি জানতে চাচ্ছি জুলাই আগস্টের আন্দোলনে আপনারা কিভাবে সম্পৃক্ত হলেন, একজন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান নাসির : জুলাই বললে তো ভুল হবে। ১৬ বছরের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন বললে ভাল হয়। আমি বলা যেতে পারে সামরিকবাহিনী বা স্বশস্ত্রবাহিনীর কর্মকর্তা, উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে সর্বপ্রথম স্বৈরাচারের শাসনকে ‘না’ বলেছিলাম। সেটা শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালের বিডিআর হত্যাকাণ্ডের যে জাতীয় তদন্ত কমিশন হয়, ঐটার আমি সদস্য ছিলাম। সেই তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট যখন বিভিন্নভাবে টুইস্ট করা হচ্ছিল, সেই তদন্ত রিপোর্টকে আমি নাকচ করে দেই (নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে)। সেই থেকে আমার ওপর বিভিন্নভাবে ইচ্ছাগতভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়। এবং এক পর্যায়ে আমি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হই। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে যে আমি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হই। চাকরি ছাড়ার সময় আমার বিরুদ্ধে যা যা করা হয়েছে, কমিশন সংক্রান্ত বিষয়ে বা বা কমিশনের পরে যা যা করা হয়েছে, পুরো বিষয়টি আমি লিখিত ডকুমেন্টেড করেছি। আমার রিলিজ লেটারে। কর্নেল থেকে শুরু করে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রিজাইন দিতে পারে না। ঐ হিসেবে আমাকে রিলিজ চাইতে হয়। অব্যাহতির চিঠি আমি ৬ পৃষ্ঠা লিখেছি। শেষ প্যারায় লিখি যে, এই চাকরি আমার জন্য আমার পরিবারের জন্য আর মোটেও নিরাপদ মনে করছি না বিধায়, আমাকে ছেড়ে দেওয়া হউক। ২০০৯ সালের অক্টোবরের ২ তারিখ জমা দেই। ২০১০ সালের জানুয়ারির ১০ তারিখ আমাকে অবসর দেওয়া হয়। এরপ আমি বেসামরিক চাকরি করি প্রথম। এরপর ঢাকায় একটা গ্রুপ অব কোম্পানিতে জয়ে›নকরি। সেখানেও আমার ওপর সরকারের নজর পরে।

দৈনিক সংগ্রাম : সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরও আপনি নিরাপদে নেই?

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান নাসির : ব্যারিস্টার তাপস ছিল ওই কোম্পানির সাথে সম্পৃক্ত। পরে সে চাপ সৃষ্টি করে। তারপর আমাকে চাকরি ছাড়তে হয়। তারপর আমি আরেকটা বিদেশী কোম্পানিতে চলে যাই চট্টগ্রামে। ঐখানেও আমার ওপর চাপ আসে। তখন পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী ছিল হাসান মাহমুদ এবং ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদ। এই দুইজনের এলাকা। সরকার বিরোধী বলে তারা দুজন আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

দৈনিক সংগ্রাম : কোম্পানিগুলোর নাম কি বলা যায় ?

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান নাসির : জি¦, জি¦। একটা হলো আনোয়ার গ্রুপ অব কোম্পানি। আমি ওইটার ল্যান্ড মার্কেটের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলাম। পরবর্তীতে ইয়াঙ্গুন করপোরেশন-কোয়িান ইপিজেড (চট্টগ্রাম নদীর ওপাড়ে) আড়াই হাজার একর জমির ওপর যে প্রজেক্ট ওইটারও এমডি ছিলাম। ওখানের ওদের আ’লীগের স্বার্থের পরিপন্থি ছিলাম বলে, তারা রাজনৈতিক ফায়দা নিতে পারছিল না ----। ওখানে আমি ২৬ লাখ স্কয়ার ফুট কন্সট্রাকশন হয়। ডেভেলপ কমপ্লিট হয়। একটা পর্যায়ে রাজনৈতিক মহল দেখে যে, আমি যদি থাকি তাহলে তারা রাজনৈতিক সুবিধা নিতে পারছে না। তখন তারা আমার পিছনে লেগে যায়। তখন আমি সেখান থেকে ছেড়ে চলে আসি। এরপর আমি চাকরি প্রার্থী না হলেও অনেকে ডেকেছে। আমি তাদের বলি যে, আমাকে নিলে সামলাইতে পারবেন কি-না সেটা আগে চেক করেন। তারপর নিয়ে বেইজ্জতি করবেন না। দেখা গেছে ফাইনাল পর্যায়ে গিয়ে অনেকে পিছু হটেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে বেকার বলতে পারেন। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি চাইছিলাম যে স্বৈরচার সরকারের পতন হউক। সবচেয়ে আমাকে ব্যাথিত করেছে যে, সরকার তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বেকবোন স্বশস্ত্রবাহিনীকে তারা ধ্বংস করছিল। প্রক্রিয়াটা ছিল বাহিনীর রাজনীতিক ওরিয়েন্টেট অফিসারাদের পছন্দ করা, অসৎ অফিসারদের প্রমোশন দিয়ে ওপরে নিয়ে এসে তাদের দিয়ে অবৈধ কাজ করানো। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য। এটা করার কারণ ছিল একজন পেশাদার অফিসারকে বললে হয়তো করবে না। এজন্য যারা রাজনৈতিক সুবিধা চায় তাদের প্রমোশন দিচ্ছিল। সেজন্যই গুম খুনসহ যত রকমের দুর্নীতি করছিল। এবং স্বশস্ত্রবাহিনীর টোটাল ওরিয়েনটেশনটাই পাল্টে দেয়। তারা এমন এমন সেনা প্রাধানদের নিয়োগ দেয় যারা বলে যে বাংলাদেশের কোন শক্র নাই। স্বাধীনতার পর থেকে মিলিটারিতে একটা ওরিয়েনটেশন ছিল -- শত্রু থাকলে সেজন্য স্বশস্ত্রবাহিনী প্রস্তুতি নেয়। সেনাবাহিনীর প্রধান যখন বলে যে, আমাদের কোন শক্র নাই। আমাদের কোন ওর উল্ফ ল্যান্ড নাই, আমরা গ্রীণ ল্যান্ড। পুরো বাহিনীর ওরিয়েনটেশন পাল্টে গেল। তখনতো এটা সেরিমোনিয়াল বাহিনী হয়ে গেলো। এজিনিসটা আমাকে কষ্ট দিচ্ছিল যে, একটা বাহিনী এবং বাহিনীর টপ লেভেলের কর্মকর্তারা যদি গুম, খুন এবং যত দুর্নীতি করতে পারবে, অবৈধ অনৈতিক কাজ করতে পারবে, তার উপরে যাওয়ার সুযোগ তত বেশি। কারণ তার দুর্বলতাটা তখন শাসকের হাতে থাকবে। এজন্য আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলাম।

দৈনিক সংগ্রাম : আপনাদের আন্দোলনের সিস্টেমটা কি ছিল ?

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান নাসির : মবিলাইজ করা। অফিসারদের মধ্যে যোগাযোগ রাখা। রাজনৈতিক দলের সাথে যোগাযোগ রাখা। কে আমাদের লাইনে আর কে বিপক্ষে এই জিনিসগুলো চিহ্নিত করছিলাম। একটা পর্যায়ে ২০২৪ এর এপ্রিলের দিকে নেক্সাস ডিফেনসেস জাস্টিস থিংকট্যাংক টা করা।

দৈনিক সংগ্রাম : তার মানে এই সংগঠনটা থিংকট্যাংক হিসেবে কাজ করছিল ?

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান নাসির : জি¦ আমরা থিংকট্যাংক হিসেবে কাজ করছিলাম। কি নামে কিভাবে প্রকাশ করলে আমরা আক্রান্ত হবো, সেই হিসেবে আমরা ভেতরে ভেতরে ঘরোয়া পর্যায়ে জিনিসটা রেখে অর্গানাইজ করি। আমরা মনে করি যে আমাদের একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে। তাহলে আমরা কোন একটা কিছু অর্জন করতে পারবো। এর মধ্যে জুনে আন্দোলন শুরু হলো। জুলাইতে গিয়ে ব্যাপক আকার ধারণ করলো। তখন আমরা অফিসাররা যারা ছিল তাদের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করে, আমরা আন্দোলনে যোগ দেই। প্রথমে আমরা স্টেইটমেন্ট বা কথাবার্তার মধ্যে থাকি। এরপর জুলাইয়ের শেষ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেই যে, আমরা আন্দোলনে নেমে যাবো। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১লা আগস্ট থেকে আমরা রাস্তায় নেমে গেছি।

দৈনিক সংগ্রাম : আন্দোলনে কি কি কর্মসূচিতে আপনারা যোগ দেন ?

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ হাসান নাসির : আমরা শহীদ মিনারে গিয়েছি। ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছি। আমরা বুঝতে পারছিলাম, যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তার একটা পরিণতিতে নিতে না পারলে বহুদিন পিছিয়ে যাবো আমরা। সেজন্য আমরা জোর দেই যে, আন্দোলনটা চলছে তা শেষ করতে হবে। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নেই যে আর ঘরে ফেরা যাবে না। আমরা তখন ছাত্রদের সাথেও যোগাযোগ করি। তাদের উৎসাহিত করি। ১,২,৩,৪,৫ আগস্টতো আমরা ফুল মাঠে। মিছিল মিটিং সব করেছি। আমরা প্রেসক্লাবে প্রোগ্রাম করেছি। ৩ তারিখে পুলিশের শটগান টিয়ার গ্যাস চলছিল। আমার সাথে অফিসাররা ছিল। তারা প্রথমে প্রোগ্রামে এটেন্ড করার পর দেখি যে, পুলিশ টিয়ার সেল মারা শুরু করেছে। সাম হাউ আমরা ডিআরইউর দিক দিয়ে বের হয়ে সেগুনবাগিচা দিয়ে বেরিয়ে আসি। এরপর থেকে আমরা প্রতিদিন মাঠে ছিলাম। চার তারিখে শহীদ মিনারে ছিলাম। ৩ তারিখেও শহীদ মিনারে ছিলাম। ৫ তারিখতো সারাদিন। সকাল থেকে রাওয়ার সামনে। ৫ তারিখে বেলা ১টার দিকে আমরা শুনতে পেলাম যে, হাসিনা চলে যাচ্ছে। এবং সেনাপ্রধান ভাষণ দিবে। এটা দিতে দিতে দেখলাম তিনটা। আল্টিমেটলি হাসিনা পালানোর পরই ভাষণটা দেয়। নিশ্চিত হওয়ার পর। তার আগে আমাদের জাহাঙ্গির গেইট ক্রস করতে দেয়নি। তখন উত্তরা থেকে একটা সমাবেশ রাওয়াতে এসেছিল। ওদের সাথে মিলে আমরা যেতে চেয়েছিলাম শাহবাগের দিকে। বাট আমাদের জাহাঙ্গীর গেইটেই আটকে দেওয়া হয়।