‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও আগামী দিনের জনপ্রশাসন’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রশাসনের শীর্ষ বর্তমান ও সাবেক আমলারা বলেছেন, রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিয়ে প্রশাসনকে আবার কলুষিত করা হলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। বিগত ১৬ বছর প্রশাসন ছিলো মিসগাইডেড। প্রশাসন ক্যাডার এখন ইতিহাসের বাঁকে অবস্থান করছে। সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলে প্রশাসন ক্যাডার অস্তিত্বের সংকটে পড়বে।

শুক্রবার রাতে বিয়াম ফাউন্ডেশন অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন গৃহায়ন ও গণপূর্তও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্টেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের(বিএএসএ) সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন বাংলাদেশ কর্মকমিশন সচিব মো. সানোয়ার জাহান ভুইয়া। সেমিনারে সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদষ্টোর মুখ্য সচিব মো. সিরাজ উদ্দিন মিয়া মুখ্য আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর নিয়াজ আহমেদ খান।

সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব মো. সিরাজ উদ্দিন মিয়া বলেছেন, প্রশাসন ক্যাডারের সামনে আত্মশুদ্ধির সময় এসেছে। এ সময় কাজে লাগিয়ে যদি অতীতের কালিমা মোচন করা সম্ভব না হয়, তাহলে প্রশাসন ক্যাডারের সামনে বিপদ অপেক্ষা করছে।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিয়ে প্রশাসনকে আবার কলুষিত করা হলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। বিগত ১৬ বছর যে প্রশাসন ছিলো মিসগাইডেড। প্রশাসন ক্যাডার এখন ইতিহাসের বাঁকে অবস্থান করছে। সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলে প্রশাসন ক্যাডার অস্তিত্বের সংকটে পড়বে।

মুখ্য সচিব বলেন, মিসগাইডডেড প্রশাসনকে সঠিক পথে আনতে কেউ কাজ করছে বলে মনে হয় না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কিংবা বিএএসএ কেউ কোনো উদ্যোগ নিয়েছে তা দৃশ্যমান নয়। আমাদের দিনব্যাপী সেমিনার করে বিগত ১৬ বছরে কি ভুলগুলো হয়েছে তা চিহ্নিত করতে হবে। বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে সেমিনার করে নিজেদের দোষ ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করা দরকার। আগামী ৬ মাস এ কাজটি করা জরুরী ভিত্তিতে করা দরকার।

মুখ্য সচিব আরও বলেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সততার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্বপালন করতে হবে। কারো পকেটে ঢুকে পড়া যাবে না। তাহলে ধ্বংসের পথে হাঁটলাম। এ পথ পরিহার করতেই হবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান বলেছেন, আমলাদের সর্বোচ্চ সাহস এবং সততার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি আরও বলেন, মনে রাখতে হবে জনগণ এখন প্রশ্ন করতে শিখে গেছে। প্রশাসনের কেউ কিছু করে পার পেয়ে যাবেনা এমনটা ভাববার কোনো কারণ নেই। টাকা পয়সা বানানোর ঝুঁকি কেউ নেবেন না। পরিণতি ভাল হবে না। বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় আগের চেয়েও দুর্নীতি বেড়েছে। এ অভিযোগ অমূলক নয়।

জনপ্রশাসন সচিব বলেন, সচিবালয়ের গেইটে একটি মেশিন বসানো গেলে দেখা যেত কে কত টাকা নিয়ে বের হচ্ছেন।

অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার বলেন, এক বছরে আমরা দুর্নীতি কমাতে পারিনি। গতকাল(বৃহস্পতিবার) দুটি অভিযোগ পেয়েছি যার একটি হচ্ছে একজন সহকারী কমিশনার (ভূমি)একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জমির নামজারি করে দেওয়ার জন্য ৩০ লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছেন। অপর অভিযোগ হচ্ছে ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি জেলায় কর্মরত একজন ইউএনও একটি কারখানার ডিজাইন অনুমোদনের জন্য ২০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছেন। মানুষকে আমরা কি করে মুখ দেখাবো। এ ভাবে চললে প্রশাসন ক্যাডার অস্তিত্বের সংকটে পড়বে।

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আটজন উপদেষ্টার ‘সীমাহীন দুর্নীতি’র প্রমাণ নিজের কাছে রয়েছে বলে দাবি করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার। অবসরপ্রাপ্ত এই সচিব বলেছেন, এই উপদেষ্টাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ হয় না, বদলিও হয় না।

আব্দুস সাত্তার তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমি খুবই হতাশ। আমলাদের চরিত্র না হয় খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের রক্তের ওপর দিয়ে চেয়ারে বসা অন্তত আটজন উপদেষ্টার সীমাহীন দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ দিতে পারব। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আট উপদেষ্টার দুর্নীতির প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না’। এ সময় উপস্থিত কর্মকর্তারা ‘ঠিক ঠিক’ বলে হাততালি দেন।

সাবেক এই সচিব বলেন, কষ্ট লাগে একজন উপদেষ্টার এপিএসের অ্যাকাউন্টে ২০০ কোটি টাকা পাওয়া গেলেও তার বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তিনি প্রশ্ন করেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো একটি মন্ত্রণালয় নূরজাহান বেগম চালাতে পারেন? স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় একজন অনভিজ্ঞ উপদেষ্টা দিয়ে চালানো ঠিক হচ্ছে?

এ বি এম আব্দুস সাত্তার আরও বলেন, অনেকে দলবাজিতে লিপ্ত। এ অবস্থা আর চলবে না। কোনো দলবাজি, চেতনার ব্যবসা আর চলবে না। তিনি আরও বলেন, আমি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে বলছি আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ইন সার্ভিস আমলাদের দলবাজি পছন্দ করেন না। আপনাদের দলবাজি ছাড়তে হবে। দুর্নীতিকে না বলতে হবে। দুর্নীতি ও দলবাজি ছাড়তে না পারলে আপনাদের কপালে দুঃখ আছে। দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। আগামীর বাংলাদেশে, এসি ল্যান্ড, ইউএনও এবং ডিসি বা অন্য কেউ যা ইচ্ছে তা করে ফেলবেন এমনটা আশা করা ঠিক না। কারণ, মানুষ এখন প্রতিবাদ করতে শিখে গেছেন। অতএব সাবধান।

আর টাকা পয়সা আয় করে কোথায় রাখবেন? ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, কোথায় রাখবেন, যেখানে টাকা রাখবেন সেখান থেকে টাকা ফেরত আনা হবে। হিসাব করে দুর্নীতি করবেন, কারণ দুর্নীতি আপনার ব্যক্তির, পরিবারের জীবন ধুলিস্ম্যাৎ করে দিতে পারে।

প্রধান আলোচক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ১৬ বছরে দেশের সব প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙ্গে চুরে খান খান করে দেওয়া হয়েছে। আর্থিক খাত, প্রশাসন, মিডিয়া, পেশাগত সার্ভিস, ব্যবসা বাণিজ্য সেক্টরে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানকে অন্য প্রতিষ্ঠানের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়তে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সব দেয়াল ভেঙ্গে দিতে হবে।

ঢাবির ভিসি আরও বলেন, ২৪ এর শহীদ পরিবারের প্রতি আমাদের ব্যক্তিগত দায় রয়েছে। তাদের আত্মত্যাগের কারণে আমরা মূল্যায়িত হয়েছি। সুতরাং সিভিল প্রশাসনকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা দলীয় গোলাম বনে গেলে পরিনতি কি হয় বিগত ১৬ বছরে দেখা গেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণ ঘটাতে হবে। প্রশাসনকে জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি করতে হবে। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক বলেছেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। প্রফেসর নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, আমি প্রস্তাব করছি শহীদ পরিবারগুলোকেও যেন জবাবদিহি কমিটিতে রাখা হয়।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধে সানোয়ার জাহান ভুইয়া বলেন, দেশ থেকে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে, আমরা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারিনি। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে। গত ১৫ বছর শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। বছর বছর নিজেদের স্বার্থের লোটপাট করতে শিক্ষা কারিকুলাম বার বার পরিবর্তন করা হয়েছে। শিক্ষাকে এক ধরনের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আমার দেশের বই ছপানোর পরিবর্তে অন্যদেশ থেকে তা ছাপানো হয়েছে। এমন অনিয়মের বিরুদ্ধে কতিপয় মিডিয়া লেখেননি, অনিয়মের পক্ষ হয়ে মিডিয়া হাউসগুলো কাজ করেছে। সামাজিক মূল্যবোধ ছিল না। মানবাধিকার লঙ্ঘন ছিল পদে পদে। নির্বিচারে হত্যা, গুম হয়েছে, কেউ টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাসন আমলে ল্যান্ড মাফিয়া, ব্যাংক মাফিয়া, মিডিয়া মাফিয়া, পরিবহন মাফিয়া ছিল শক্তিশালী। যারা ফ্যাসিসদের হয়ে কাজ করেছে। দলের না হলে পদোন্নতি দেয়া হতো না।

সেমিনারে শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ শ্রাবন্তী বলেন, আর কোন আমলা যেন রাজনৈতিক দলের না হয়ে কাজ করেন। মনে রাখতে হবে হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট তৈরির ক্ষেত্রে আমলাদের ভূমিকা ছিল বেশি।

শহীদ আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী বলেন, আমরা এখনও বিচার পাইনি, সবার আগে বিচার হউক। খুনি হাসিনাসহ সকল খুনিদের বিচার নিশ্চিত করা হউক। শহীদ আনাসের মা সানজিদা খান দ্বীপ্তি বলেন, তার ছেলের লেখা চিঠি যেন পাঠ্য পুস্তকে লিপিবন্ধ করা হয়।

শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধর ভাই স্নিগ্ধ বলেন, পৃথিবীর অন্যকোন দেশে এমন বর্বর হত্যাকান্ড করেনি, শুধু মাত্র ক্ষমতায় থাকার জন্য। আমার ভাই শহীদ হওয়ার পর থেকে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আমলারা আমাদের ঘুমাতে দেয়নি। আমাদের গুম করতে চেয়েছিল, আমরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। জোর করে খুনি হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে প্রাণ নাশেরও হুমকি দেওয়া হয়েছিল।