রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান শুধু জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগে সম্ভব নয়। জনগণের ঐক্য, আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর মাধ্যমে এর রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘অ্যামপ্লিফাইং দ্য রোহিঙ্গা ভয়েসেস অ্যান্ড অ্যাসপাইরেশন: অ্যা স্ট্রাটেজিক ডায়ালগ এহেড অব ইউএনজিএ ২০২৫’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথা বলেন। জাতিসংঘ অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংক্রান্ত কনফারেন্সকে মাথায় রেখেই এই কর্মশালা আয়োজন করে নীতি গবেষণা কেন্দ্র। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন নীতি গবেষণা কেন্দ্রের ট্রাস্টি অধ্যাপক শেখ তৌফিক এম হক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ সুফিউর রহমান। প্রধান অতিথি ছিলেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। বক্তব্য রাখেন নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) বাংলাদেশ উপকার্যালয়ের প্রধান পিটার কান প্রমুখ। প্রথম সেশনের শুরুতে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন বাংলাদেশ সরকারের সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ সুফিউর রহমান। তিনি এই আলোচনার প্রেক্ষাপট ও সংকট সমাধানে বিভিন্ন প্রস্তাবও তুলে ধরেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের দ্বারা ফ্যাসিবাদী শাসনামলে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা নীতি প্রচ-ভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। রোহিঙ্গা সমস্যাকে আমাদের একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে। তিনি বলেন, এটি শুধু একটি মানবতাবাদী সমস্যা নয়, এটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ও সামরিক সমস্যা। এটি একটি ভূ-রাজনৈতিক সমস্যাও বটে। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা সংকটে আমাদের খুবই শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রয়োজন। দুঃখজনকভাবে ৮ বছরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই সংকট সমাধানে যথেষ্ট সক্রিয় হতে দেখা যায় নি। এটি মানবিক ইস্যু ও আন্তর্জাতিক সংকট। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আসিয়ানকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। এই সংকটের সমাধান করতে সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। দুঃখজনক হলেও সত্য এ সমস্যা সমাধানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বিত প্রচেষ্টা নেই।

উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত বলেন, আমরা কূটনৈতিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি, মিলিটারি এই ধরনের সংকট সমাধান করতে পারে না। রাজনৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি এ সংকট সমাধানে প্রয়োজন কূটনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত পদক্ষেপ। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমিতে ফেরাতে বাংলাদেশ সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সম্মান ও নিরাপত্তার সঙ্গে নিজের মাতৃভূমিতে ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার। এম সাখাওয়াত আরও বলেন, আন্তর্জাতিক উদ্যোগে এই সংকটের দ্রুত সমাধান হওয়া জরুরি। আমরা চাই না এর সমাধান আরও প্রলম্বিত হোক।

সংলাপে আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম রোহিঙ্গা জনগণের বিরুদ্ধে নৃশংসতা ও গণহত্যার জন্য দায়ীদের বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার দাবি জানান। নুরুল ইসলাম বলেন, সব অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা, সহিংসতার পুনরাবৃত্তি রোধ করা, আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা তোলা, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ, সম্মানজনক এবং টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার দাবি জানা নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, তাদের নাগরিকত্ব ও জাতিগত পরিচয় সুরক্ষিত রাখা এবং উপযুক্ত শিক্ষা ও পুনর্বাসনের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি প্রত্যাবর্তনের পথে রাজনৈতিক বাধা মোকাবিলার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমারে উদ্ভূত রাজনৈতিক সমস্যা, যার স্থায়ী সমাধানও মিয়ানমারেই আছে।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) বাংলাদেশ উপকার্যালয়ের প্রধান পিটার কার্ন বলেন, রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমারে উদ্ভূত রাজনৈতিক সমস্যা, যার স্থায়ী সমাধানও মিয়ানমারেই আছে। বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে যে উদারতা প্রদর্শন করেছে, তার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের কাছ থেকে আরও স্বীকৃতি প্রাপ্য।

পিটার কার্ন বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানে সমর্থন দিয়ে স্বীকার করেছে, এই বিশাল বোঝা বাংলাদেশ একা বহন করতে পারবে না। এর মাধ্যমে বিশ্ব বাংলাদেশের ভূমিকা ও রোহিঙ্গাদের স্বদেশে নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করছে।

‘অ্যামপ্লিফাইং দ্য রোহিঙ্গা ভয়েসেস অ্যান্ড অ্যাসপাইরেশন: অ্যা স্ট্রাটেজিক ডায়ালগ এহেড অব ইউএনজিএ ২০২৫’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলা হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহ কমে যাওয়ায় রোহিঙ্গা সংকট জটিল হচ্ছে। অর্থের ঘাটতি প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতা সীমিত করছে। বড় দেশগুলো শুধু নিজেদের স্বার্থ দেখছে, আঞ্চলিক দেশগুলোও তেমন সক্রিয় নয়। বাংলাদেশে মানবিক সহায়তা, শিক্ষা, কাজের সুযোগ ও চলাচলের স্বাধীনতার দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হলেও রাখাইন ও মিয়ানমারে সহিংসতার বিষয়টি প্রায় অবহেলিত। নিরাপত্তা–সংক্রান্ত প্রতিবেদনে পক্ষপাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে; রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর কার্যক্রম বেশি তুলে ধরা হয়, আর রাখাইন জাতীয়তাবাদীদের কর্মকা- তেমন আলোচনায় আসে না।

সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে প্রবন্ধে বলা হয়, জাতিগত ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব এড়াতে আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া এবং রাজনৈতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি দেশের নিরাপত্তা হুমকিমুক্ত রাখতে মাদক, মানব পাচার, সীমান্ত লঙ্ঘন এবং জেলেদের অপহরণ বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো এবং সমাজে সমান অধিকারপ্রাপ্ত নাগরিক হিসেবে একীভূত করার জন্য পন্থা নির্ধারণ করা। মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সংযোগ বৃদ্ধি করা।