বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাষ্ট্রকাঠামো নির্ধারণের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য রূপরেখা তৈরির লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় সনদ (চার্টার) ঘোষণার জন্য কাজ করছে এই কমিশন। ইতোমধ্যে দেশের ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আলোচনা আগামী ২৭ মে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। রাজনৈতিক দলের আলোচনায় পাঁচটি সংস্কার কমিশনের অনেকগুলো সুপারিশ বা প্রস্তাবের বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও ক্ষমতার ভারসাম্যসহ মৌলিক প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেছে বলে কমিশন সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দ্বিতীয় দফার আলোচনা শেষ করে দলগুলোর ঐক্যমতের খসড়া তৈরি করে তা জাতীয় সনদ আকারে চূড়ান্ত করা হবে, যা জুলাই মাসেই প্রকাশের লক্ষ্য রয়েছে। যদিও কমিশনের মেয়াদ ১৫ আগস্ট পর্যন্ত, তবুও তার আগেই কাজ সম্পন্ন করতে আগ্রহী সংশ্লিষ্টরা। প্রথম পর্যায়ের আলোচনার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দলগুলোর সঙ্গে শিগগিরই দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শুরু হবে। আগামী ২৭ মে এ আলোচনা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সময় দিতে পারলে তার বক্তব্যের মাধ্যমে দ্বিতীয় দফায় আলোচনা শুরু হবে বলে সূত্র জানিয়েছে। এ পর্যায়ে মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবগুলো আলোচনায় গুরুত্ব পাবে। যেসব বিষয়ে মতভিন্নতা আছে, সেগুলো নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হবে। এক্ষেত্রে দলগুলোর মধ্যে যেখানে পূর্ণ, আংশিক কিংবা দ্বিমত রয়েছে, তা তালিকাভুক্ত করে নিয়ে আলোচনা এগিয়ে নেওয়া হবে। আর এ আলোচনা তিন থেকে চার দিন পর্যন্ত চলতে পারে। ঈদের পর তারা সকল বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করবে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি সমন্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সনদ তৈরি করা সম্ভব বলে মনে করছে কমিশন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, অধিকাংশ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমত পোষন করেছে। তবে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। এনসিসি নিয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ মতামত পাওয়া গেছে। উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে বেশিরভাগ দল একমত হলেও, এর কাঠামো ও কার্যপ্রণালী কেমন হবেÑসে বিষয়ে ভিন্নতা রয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে একটি ‘ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা’র জায়গায় পৌঁছানোই এখন মূল লক্ষ্য বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য এবং নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা এখন একমত, দ্বিমত ও আংশিক মতের জায়গাগুলো চিহ্নিত করছি। দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শেষে একটি চূড়ান্ত জাতীয় সনদ দাঁড় করানোর চেষ্টা থাকবে। জুলাইয়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে চাই, তবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতার ওপর।
কমিশন সূত্রমতে, আলোচনায় মৌলিক যেসব পরিবর্তনের প্রস্তাব আছে, সেগুলো মূলত সংবিধান সম্পর্কিত। সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে সংস্কারের যেসব উদ্দেশ্যের কথা উল্লেখ করেছে, তার অন্যতম হলো ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার উত্থান রোধ এবং রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গÑনির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে এবং এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা যাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে না যায়, সে জন্য সংবিধানে বেশ কিছু সংস্কার আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমানো; এক ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না; একই ব্যক্তি একাধারে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলের প্রধান হতে পারবেন না; সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের জন্য জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন; আইনসভা (সংসদ) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা এবং উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বপদ্ধতিতে (একটি দল সারা দেশে যত ভোট পাবে, সে অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে) নির্বাচন; অর্থবিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যরা তাঁদের দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা পাবেন ইত্যাদি।
এসব প্রস্তাবের মধ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করার প্রস্তাবের সঙ্গে প্রায় সব দলই একমত হয়েছে; কিন্তু নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা আছে। অন্য প্রস্তাবগুলোর ক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মতপার্থক্য বেশি।
জুলাই সনদ নিয়ে জামায়াতের নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের গত ১৮ মে কমিশনের সাথে আলোচনার পর সংবাদিকদের বলেছেন, গণভোটের মাধ্যমে আমরা জুলাই চার্টার (জুলাই সনদ) হোক, অথবা ন্যাশনাল চার্টার (জাতীয় সনদ) হোক এবং চার্টারের বাইরেও যদি গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইস্যু থাকে, সেটাকে ইনক্লুড (অন্তর্ভুক্ত) করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী গণভোট চায়। কারণ, গণভোট হচ্ছে সব মানুষের মনের প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষই তো এখানে সিদ্ধান্ত নেবে। গণভোটের মাধ্যমে এর আইনগত একটি ভিত্তি হবে। এর সামাজিক ও রাজনৈতিক ইমপ্যাক্ট (প্রভাব) থাকবে। সেজন্য জামায়াত এটাকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য গণভোট চাচ্ছে।’
এনসিসি ও সাংবিধানিক পদে নিয়োগ
ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগÑরাষ্ট্রের এই তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ (এনসিসি) গঠন করার প্রস্তাব ছিল সংবিধান সংস্কার কমিশনের। তাদের প্রস্তাবে বলা হয়, প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানদের এবং বিভিন্ন সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য এই কাউন্সিল রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠাবে। রাষ্ট্রপতি তাঁদের নিয়োগ দেবেন।
বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে অন্য যেকোনো কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে হয়। এনসিসি গঠন করা হলে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমবে। তবে এ প্রস্তাবের সঙ্গে বিএনপি একমত নয়। বিএনপি এই কাঠামোকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নযোগ্য মনে করছে না। দলটির মতে, এনসিসি একটি নতুন ধারণা, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্যে আগে কখনো প্রয়োগ হয়নি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী কাঠামোটির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলেও এনসিসির কার্যকারিতা ও গঠনতন্ত্রে ‘মূলগত সংস্কার’ চায়। অপরদিকে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এনসিসি গঠনকে সমর্থন দিয়েছে, যারা মনে করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় এবং সংসদীয় ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিতে এনসিসি অপরিহার্য।
প্রধানমন্ত্রী সংক্রান্ত
প্রধানমন্ত্রীর পদের বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। একই ব্যক্তি একাধারে প্রধানমন্ত্রী, দলের প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না। এই দুটি প্রস্তাবে এনসিপি একমত। তবে এ দুটি প্রস্তাব নিয়ে ভিন্নমত জানিয়েছে বিএনপি। বিএনপি চায় কোনো ব্যক্তি টানা দুবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিরতি দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, এমন বিধান। আর দলের প্রধান, সরকারপ্রধান ও সংসদ নেতা কে হবেন, তা দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। এ ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান হলো একই ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এবং দলের প্রধান থাকতে পারবেন না। এক ব্যক্তি সারা জীবনে ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না।
সংবিধানের মূলনীতি, জরুরি অবস্থা জারির বিধান, সংবিধান সংশোধনপ্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক চুক্তি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপদ্ধতি, পিআর পদ্ধতিতে ভোট, সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচনপদ্ধতিসহ কিছু প্রস্তাব নিয়েও এখনো মতপার্থক্য আছে।
তবে এসব মৌলিক বিষয়ের বাইরে সংবিধান ও অন্য চারটি সংস্কার কমিশনের বেশ কিছু প্রস্তাবের সঙ্গে দলগুলো একমত হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষে বিএনপি জানিয়েছিল, তারা বেশির ভাগ সুপারিশের সঙ্গে একমত। জামায়াতে ইসলামী বলেছিল, ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে তারা ১২০টির বেশি সুপারিশে একমত হয়েছে।
উল্লেখ্য, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য গত বছরের অক্টোবরে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে এ কমিশন।
ঐকমত্য তৈরির অংশ হিসেবে পুলিশ সংস্কার কমিশন ছাড়া সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে স্প্রেড শিটে (ছক) রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে মতামত নেয় ঐকমত্য কমিশন। যেসব সুপারিশের বিষয়ে আংশিক একমত বা ভিন্নমত ছিল, সেগুলো নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত ২০ মার্চ শুরু করে ১৯ মে পর্যন্ত দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়েছে। দুই মাসে ৩৩টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে বিএনপি তিন দিন, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি দুই দিন করে প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় অংশ নেয়।