চলতি সপ্তাহে ১৭ পুলিশ কর্মকর্তা বরখাস্ত

বাধ্যতামূলক অবসর, বেতন-ভাতা বন্ধ, পাসপোর্ট জব্দ ও মামলা দায়েরের পর পলাতক পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে পলাতক রয়েছেন ১৮৭ জন পুলিশ সদস্য। এদেরকে কাজে যোগ দেয়ার অনুরোধ জানানো হলেও সাড়া মেলেনি। এদের বেতন বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে থানায় মামলা করা হচ্ছে। এমনকি তাদের গ্রেপ্তারে আলাদা টিমও গঠন করেছে পুলিশ। তারা যেন বিদেশে পালাতে না পারেন, সে জন্য বাতিল হচ্ছে তাদের অফিশিয়াল পাসপোর্ট। এরপরও তাদের চাকরিচ্যুতির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যদিও পুলিশ সদস্যরা বলছেন এটি তাদের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ।

পলাতকদের মধ্যে কয়েকডজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়েছেন। সাবেক এসবি প্রধান, ডিএমপি কমিশনার, ডিবি প্রধানসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা পলাতক রয়েছেন, যাদের অনেকের অবস্থান এখনো শনাক্ত করা যায়নি। ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন তারা কাজে যোগ না দিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। পলাতক কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন ১ জন ডিআইজি, ৭ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, ২ জন পুলিশ সুপার, ১ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ৫ জন সহকারী পুলিশ সুপার, ৫ জন পুলিশ পরিদর্শক, ১৪ জন এসআই ও সার্জেন্ট, ৯ জন এএসআই, ৭ জন নায়েক এবং ১৩৬ জন কনস্টেবল। পলাতক এসব পুলিশ কর্মকর্তারা ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ছাত্র-জনতার ওপর সশস্ত্র অবস্থায় ঝাপিয়ে পড়েছিল বলে অভিযোগ আছে। এরমধ্যে সাবেক আইজিপিসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ভেঙে পড়ে পুলিশ বাহিনী। অনেক পুলিশ সদস্য ছুটি না নিয়ে কর্মস্থলে যোগদান করার পরও উধাও হয়ে যান। দীর্ঘদিন ধরে কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া এমন ঊর্ধ্বতন তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে সরকার। চলতি সপ্তাহে ১৭ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রামের সাবেক ডিআইজিসহ আরও তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ-১ শাখা থেকে পৃথক তিনটি প্রজ্ঞাপনে বরখাস্তের আদেশ জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনগুলোতে সই করেন উপসচিব নাসিমুল গনি। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চট্টগ্রাম রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি বর্তমানে রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমির ডিআইজি নূরে আলম মিনা কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে গত ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত। ডিএমপি ডিবির সাবেক ডিসি বর্তমানে বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত মানস কুমার পোদ্দার কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে গত বছরের ১৮ অক্টোবর থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত। এর আগে, গত ২৬ জুন ছুটি না নিয়ে কর্মস্থলে যোগদান না করায় তিনজন পুলিশ সুপার, আটজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও দুজন সহকারী পুলিশ সুপারসহ ১৪ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদরদফতর সূত্র জানায়, গণ-অভ্যুত্থানের পর গত ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩০ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে, যাদের মধ্যে হাসিনা সরকারের আমলের প্রভাবশালী কর্মকর্তারা রয়েছেন। হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরপর পুলিশের কার্যক্রমে গতি ফিরিয়ে আনতে ১১ আগস্ট সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন পুলিশকে ১৪ আগস্টের মধ্যে কাজে যোগ দেওয়ার সময় নির্ধারণ করে দেন। এর আগে ৭ আগস্ট পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ময়নুল ইসলাম পুলিশ সদস্যদের ৮ আগস্টের মধ্যে নিজ নিজ ইউনিটে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ১১ মাসেও পুলিশের ১৮৭ জন সদস্য কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন।

সূত্র মতে, ৫ আগস্টের পর নিরাপত্তার স্বার্থে সেনানিবাসে আশ্রয় নেন ৫১৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা। তাদের অনেকে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, অনেকে বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন আবার কেউ কেউ আত্মগোপনেও রয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে গত বছর নবেম্বরে জানানো হয়, পুলিশের ১৮৭ জন সদস্য ছাড়া সবাই কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। তাদের তথ্যানুযায়ী, অনুপস্থিত থাকা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ডিআইজি (উপমহাপরিদর্শক) রয়েছেন একজন, অতিরিক্ত ডিআইজি সাতজন, পুলিশ সুপার দুজন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার একজন, সহকারী পুলিশ সুপার পাঁচজন, পুলিশ পরিদর্শক পাঁচজন, এসআই ও সার্জেন্ট ১৪ জন, এএসআই ৯ জন, নায়েক সাতজন ও কনস্টেবল ১৩৬ জন। এসব কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করে চাকরিচ্যুতির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত শুধু ঢাকায় পুলিশের অন্তত ৯৯ জন কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা, অপহরণে জড়িত থাকার অভিযোগে মামলা হয়েছে।

সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়েছে। মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসছে কোন কোন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি গুলীর নির্দেশ দিয়েছেন এবং কারা গুলী করেছেন। সেসব কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি যারা বুঝতে পারছেন তাদের গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের কয়েকজন পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের কাছে পলাতক ১৮৭ জনের যে তালিকা তাদের মধ্যে প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিএমপি) পুলিশের সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) বিপ্লব কুমার সরকার ও ডিএমপির ট্রাফিকের (দক্ষিণ) যুগ্ম পুলিশ কমিশনার এস এম মেহেদী হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের সময় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। সরকার পতনের পর তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়। হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে তিনি কারাগারে। ১৩ আগস্ট এসবির অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, রংপুর মহানগর পুলিশের কমিশনার (ডিআইজি পদমর্যাদার) মো. মনিরুজ্জামান ও পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আবদুল বাতেনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। তাদেরসহ এ পর্যন্ত ৩০ জন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়। পুলিশের পলাতক কর্মকর্তাদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তাকে এখনো চাকরিচ্যুত করা হয়নি। তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি হত্যা ও হত্যাচেষ্টার মামলা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হারুন অর রশীদ বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম ইউনিয়ন সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন আরেক পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলেছে, কাজে যোগ না দেওয়া শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন-ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, ডিবির সাবেক যুগ্ম কমিশনার খোন্দকার নুরুন্নবী, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান, রংপুর মহানগর পুলিশের (আরপিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার উত্তম কুমার পাল এবং পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার। আরপিএমপির উপপুলিশ কমিশনার মো. আবু মারুফ হোসেন, আরপিএমপি ডিবির উপপুলিশ কমিশনার মো. শাহ নূর আলম, ডিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মফিজুর রহমান ও মো. ইফতেখার মাহমুদ, আরপিএমপির সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আরিফুজ্জামান ও মো. আল ইমরান হোসেন এবং সিরাজগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার রানা। পরিদর্শক পদে কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া কর্মকর্তারা হলেন লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানার সাবেক ওসি মো. মাহফুজার রহমান, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ মডেল থানার পরিদর্শক খাদেমুল বাহার বিন আবেদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর সার্কেলের পরিদর্শক মো. ইউসুফ হাসান, ডিএমপির পরিদর্শক জাকির হোসাইন ও ঢাকা জেলা পুলিশের পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন প্রমুখ। এরা সবাই সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা।

পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব পলাতক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনের নামে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। সম্প্রতি এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, যারা এখন আর পুলিশ বাহিনীতে নেই, তারা এখন সন্ত্রাসী। তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়াও পলাতক ও চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাদের অফিশিয়াল পাসপোর্ট বাতিলের প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছে; যাতে তারা দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন। পাসপোর্ট অধিদপ্তর ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্র চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, চাকরিচ্যুত করা এটি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়ার বিষয়। যখন কেউ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকে বা পলাতক থাকে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক ঘটনা। তিনি বলেন, পলাতকদের বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুতির বিষয়টি এখন কোন পর্যায় আছে এ বিষয়ে তথ্য এখনো হালনাগাদ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পুলিশের তিনটি শাখা এর তথ্য হালনাগাদ করে। এটা হচ্ছে প্রক্রিয়াগত বিষয়।