পলিসি রিসার্চ এন্ড স্টাডিজ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘ফ্যাসিবাদ রোধে নির্বাচনী সংস্কার : সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি কি সমাধান শীর্ষক এক জাতীয় সংলাপে দেশের বিশিষ্টিজনেরা বলেন, জাতীয় নির্বাচন পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঠেকাবে এবং সরকারি দলকে ফ্যাসিস্ট হতে প্রতিরোধ করবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর হবে। শাসন ব্যবস্থায় আর ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে না। আমরা ভালো নির্বাচনের দিকে যেতে চাই। ফ্যাসিবাদমুক্ত করার এখনো বহু পথ বাকি আছে। আমাদের মিনিমাম স্ট্যাবল গণতান্ত্রিক পথের দিকে যেতে হবে। পিআর পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হলে এখনো বহুপথ যেতে হবে। পিআরের বিভিন্ন মডেল নিয়ে গবেষণা করে বাংলাদেশের জন্য কার্যকর একটা মডেল বের করতে হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আয়োজিত এক জাতীয় সংলাপে তারা এইসব কথা বলেন। মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটিতে সূচনা বক্তব্য দেন ড. আবদুল মান্নান। কোরআন তেলাওয়াত করেন সাজেদুর রহমান। অনুষ্ঠানে ‘ফ্যাসিবাদ রোধে নির্বাচনী সংস্কার : সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি কি সমাধান? শিরোনামে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকসের ডীন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওয়ারেসুল করিম। সংলাপে অংশ নেন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারপারসন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী, বিশিষ্ট আইনজীবী এস এম কামাল উদ্দিন, ড. মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ ইফতেখার তারিক, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির যুগ্ম আহবায়ক অ্যাডভোকেট মুজাহিদ ইসলাম শাহিন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামীমা তাসনীম, ওয়ান ইনিশিয়েটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্টের ডিস্টিংগুইস ফেলো এবং সিটি ইউনিভার্সিটির ডীন প্রফেসর ড. জুলফিকার হাসান, বিআইআইটির মহাপরিচালক ড. মোঃ আব্দুল আজিজ, লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট শাহ আবদুল হালিম, নয়া দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এডভান্স স্টাডিজ এন্ড থটসের ডেপুটি ডিরেক্টর ড. মহিউদ্দীন সরকার, সিটিজেন ইনিশিয়েটিভের কো-ফাউন্ডার মোহাম্মদ তালহা, মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার কর্মী মাহবুব হক, ইমপ্যাক্ট ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এনায়েত হোসাইন জাকারিয়াসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, তরুণ উদ্যোক্তা ও গবেষকবৃন্দ।

মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ওয়ারেসুল করিম বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররা কিন্তু শুধু চাকরির জন্য ত্যাগ স্বীকার করেনি। তারা চেয়েছিল ন্যায়বিচার সবক্ষেত্রে। তারা সাংবিধানিক স্বৈরাচারকে উৎখাত চেয়েছিল। তারা বলেছিল উই ওয়ান্ট জাস্টিস। তারা রাষ্ট্রের সবখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে আন্দোলন করেছিল। নির্বাচনী ব্যবস্থায়ও তাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। তিনি তার কী-নোটে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিভিন্ন দেশের চিত্র তুলে ধরেন ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি মিশ্র পিআর পদ্ধতির প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তাঁর গবেষণায় বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ইসরাইল স্টাইলে সরলীকৃত পিআর সিস্টেমের সুযোগ নেই। তিনি নিউজিল্যান্ডের বিদ্যমান পিআর পদ্ধতি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত বলে প্রমাণ করেন।

বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, নির্বাচন আসন্ন এবং এখন চাই সঠিক পদ্ধতিতে নির্বাচন। অতীতে নির্বাচন নিয়ে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগুতে হবে। পিআর সিস্টেম আমরা চেয়েছি। নির্বাচনের প্রতিটি দল প্রার্থী ঘোষণা করবে। তুরস্কে পিআর পদ্ধতি আছে, ইউরোপে আছে। পিআর পদ্ধতি আমাদের জন্য ভালো হবে। জাতীয় নেতৃবৃন্দ ঠিক করবেন। তরুণরা ত্যাগ শিকার করে রক্ত দিয়ে স্বৈরাচার মুক্ত করেছে। আমরা আগামী দিনে এক হবো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারপারসন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদমুক্ত করা দরকার। এখন রাজনৈতিক বিরোধ বেড়ে গেছে। আমরা আশা করেছিলাম তারা এক হয়ে কাজ করবে। আমরা ভালো নির্বাচনের দিকে যেতে চাই। ফ্যাসিবাদমুক্ত করার এখনো বহু পথ বাকি আছে। আমাদের মিনিমাম স্ট্যাবল গণতান্ত্রিক পথের দিকে যেতে হবে। পিআর পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হলে এখনো বহুপথ যেতে হবে। পিআরের বিভিন্ন মডেল নিয়ে গবেষণা করে বাংলাদেশের জন্য কার্যকর একটা মডেল বের করতে হবে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ ইফতেখার তারিক বলেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাই। নির্বাচনের জন্য অল্প কয়েকমাস সময় থাকলেও, এ সময়ের মধ্যে পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন সম্ভব বলে আমরা মনে করি। পিআর পদ্ধতি সবার জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মুজাহিদ ইসলাম শাহিন বলেন, আমরা উচ্চ কক্ষে পিআর চাই। শত্তিশালী বিচারব্যবস্থা চাই। মুক্ত মিডিয়া চাই, গত ১৭ বছরে মিডিয়া কী ভূমিকা পালন করেছে আপনারা জানেন। অনেক দলের মধ্যে গণতন্ত্র নেই। দলের মধ্যে ভোট কেনাবেচা হয়। টাকা দিয়ে কোটিপতিরা চলে আসে রাজনীতিতে। দলের মধ্যে আত্মীয়করণ করা হয়। এসব থেকে বের হতে হলে পিআর পদ্ধতি দরকার।

বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমীন বলেন, ১৫-১৬ বছরের ফ্যাসিবাদের মাধ্যমে আমরা অত্যাচারিত। নতুন করে ফ্যাসিবাদের উত্থান প্রতিরোধের এখন উত্তম সময়। আমি মনে করি, ৩০০ আসন হবে প্রচলিত নির্বাচনে। আর ৩০০ আসন হবে পিআরে। আমরা মিশ্র পদ্ধতির নির্বাচন চাই। নিউজিল্যান্ডে যেটা আছে। আমরা আপনাদের প্রস্তাবিত মিশ্র পিআর প্রথার সাথে একমত। ফ্যাসিবাদ যাতে আর না আসে সেই ব্যবস্থা চাই।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামীমা তাসনীম বলেন, বর্তমান নির্বাচন সিস্টেম সমস্যাজনক। এখানে টাকা ও পেশী শক্তির কারণে শামীম ওসমানের মত মানুষ সংসদ সদস্য হলেও ড. কামালের মত ব্যক্তি নির্বাচিত হতে পারে না। এর থেকে উত্তরণে পিআর সিস্টেম একটা ভালো পদ্ধতি। এখানে প্রত্যকটি ভোটের মূল্যায়ন হয়।

ওয়ান ইনিশিয়েটিভ রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্টের ডিস্টিংগুইস ফেলো এবং সিটি ইউনিভার্সিটির ডীন প্রফেসর ড. জুলফিকার হাসান বলেন, বিশ্বের ৯৯ দেশে পিআর আছে। ৩০০ আসনে প্রচলিত নিয়মে এবং বাকি আসনে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হওয়া দরকার।

বিআইআইটির মহাপরিচালক ড. মোঃ আব্দুল আজিজ বলেন, ৩০০ আসন ঠিক রেখে ১০০ বাড়িয়ে পিআর সিস্টেম করা যেতে পারে। তিনি মিশ্র পদ্ধতির পিআর বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলোর প্রতিও গুরুত্বারোপ করেন।

লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট শাহ আবদুল হালিম তাঁর আলোচনায় বলেন, সারা দেশে আওয়ামীগ রন্দ্রে রন্দ্রে বসে আছে। এদের থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। ফ্যাসিবাদ মানে অর্থের পুঁজা, কালো টাকার ব্যবহার। এসব থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর আভ্যন্তরীণ সংস্কারও দরকার। না হয়, আবারো টাকাওয়ালারাই নির্বাচিত হবার সুযোগ থেকে যাবে।

নয়া দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী বলেন, তুরস্কে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি আছে। সেখানে স্থানীয়ভাবে প্রতিনিধি যেমন নির্বাচন করা সম্ভব, আনুপাতিক হারেও আসন বন্টনের একটা মিশ্র সিস্টেম বিদ্যমান। এধরণের উদাহরণ আমাদের দেশের জন্য মিশ্র পিআর সিস্টেম প্রবর্তনে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হতে পারে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এডভান্স স্টাডিজ এন্ড থটসের ডেপুটি ডিরেক্টর ড. মহিউদ্দীন সরকার বলেন, বর্তমান সময়ে পিআর-এর গুরুত্ব বেড়েছে। নেতৃত্ব বাছাই পদ্ধতি, পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে উত্তম। কেন্দ্র দখল রোধ হবে, রাতের ভোট বন্ধ হবে না। এ কারণে পিআর পদ্ধতির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। পিআর পদ্ধতিতে সারা বিশ্বে এক সাথে ভোট করা যাবে। তা না হলে বহুদলীয় গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে।

সিটিজেন ইনিশিয়েটিভের কো-ফাউন্ডার মোহাম্মদ তালহা বলেন, পিআর সিস্টেম নির্বাচনে যে মৌলিক চ্যালেঞ্জগুলো আছে সেগুলো কিভাবে সমাধান করা যায়, সেগুলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। তরুণ প্রজন্ম পিআর পদ্ধতি নিয়ে সচেতন হলে আমাদের আগের প্রজন্ম এই নতুন পদ্ধতিতে কনভিন্স হবে কিনা? তাছাড়া ইলেকশন কমিশন এই টাইপের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত কিনা। পাশাপাশি দেশের স্থিতিশীলতা এবং পার্টির মধ্যে অটোক্রেসি আরো বৃদ্ধি পাবে কিনা তা আমরা কিভাবে বুঝবো?

মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার কর্মী মাহবুব হক বলেন, সেই সুশীল সমাজের প্রতিনিধি আজ কোথায় যখন স্বৈরাচার দেশজুড়ে অত্যাচার চালিয়েছিল। আমরা ৫০ সাধারণ পদ্ধতিতে এবং ৫০ পিআর পদ্ধতিতে চাই। আর জনগণ কি বলছে তাদের কথাগুলো আসুক।

ইমপ্যাক্ট ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এনায়েত হোসাইন জাকারিয়া বলেন, গণঅভুত্থান পরবর্তী সময়ে আমাদের হাতে যে সুযোগ এসেছে, তা আমরা হাতছাড়া করতে চাই না। ভবিষৎতে ফ্যাসিবাদ রোধে ত্রুটিমুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি অনুসন্ধান জরুরি।

পরিশেষে সভাপতির ভাষণে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রব সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং বলেন, ফ্যাসিবাদের মূল উৎপাটনের জন্য সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন একটি কার্যকর পদ্ধতি। যখন সুযোগ এসেছে, তখন সঠিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সবাইকে এক চিন্তায় আসতে হবে। যেন সবার মতামত প্রতিফলন করা যায়।