দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় আমদানীকৃত এলএনজির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। কিন্তু আমাদের এলএনজি টার্মিনালের সক্ষমতা মাত্র এক হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বর্তমান চাহিদার তুলনায় সীমিত। নতুন এলএনজি টার্মিনাল না হওয়া পর্যন্ত এবং দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধানে সাফল্যের অভাবে আগামী দুই-তিন বছর জ্বালানিসংকট আরো তীব্র হতে পারে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশীয় উৎস থেকে পাওয়া গ্যাসের প্রতি ঘনমিটার গড় মূল্য পড়েছে ৩.৩৯ টাকা। একই পরিমাণ গ্যাস আমদানিতে খরচ পড়েছে ৬৮.৭১ টাকা।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, দেশে গ্যাসের বাড়তি চাহিদা পূরণে ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর, অর্থাৎ গত সাত অর্থবছরে এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। এই সময়ে এলএনজিতে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৩৬ হাজার ৭৬৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এসব তথ্য জানা গেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশীয় উৎস থেকে পাওয়া ৭২.২১ শতাংশ গ্যাসের দাম পড়েছে ৬ হাজার ৬২৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। একই সময়ে আমদানিকৃত ২৬.৮৯ শতাংশ গ্যাসের দাম পড়েছে ৪৩ হাজার ৫৯১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশীয় উৎস থেকে পাওয়া ১৯ হাজার ৫৬৩ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ঘনমিটার, আর আমদানি করে যোগান দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ১৯৭ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন ঘনমিটার। রাষ্ট্রীয় ৩টি কোম্পানির উৎপাদিত গ্যাস প্রতি ঘনমিটারের গড় মূল্য পড়েছে ১.৪৪ টাকা। বহুজাতিক কোম্পানির ৪ ফিল্ডের গ্যাসের দাম পড়েছে ৪.৬৮ টাকা দরে।

রাষ্ট্রীয় একমাত্র অনুসন্ধান ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যোগান দিয়েছে ১ হাজার ১৪৮ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন ঘনমিটার, কোম্পানিটিকে ৪ টাকা হারে দাম পরিশোধ করে পেট্রোবাংলা। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড যোগান দিয়েছে ৫ হাজার ৩২৬ দশমিক ৯৯ মিলিয়ন ঘনমিটার, সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড যোগান দিয়েছে ১ হাজার ৩৪৯ দশমিক ১১ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস। কোম্পানি দু’টিকে ১ টাকা হারে বিল পরিশোধ করা হয়েছে। অন্যদিকে একই সময়ে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি (আইওসি) শেভরন, টাল্লোর অধীনে থাকা বিবিয়ানা, মৌলভীবাজার, জালালাবাদ ও বাঙ্গুরা থেকে যোগান এসেছে ১১ হাজার ৭৩৯ দশমিক ৩২ মিলিয়ন ঘনমিটার। কোম্পানিগুলোকে চুক্তি অনুযায়ী পরিশোধিত গ্যাসের গড় মূল্য পড়েছে ৪.৬৮ টাকা।

একই সময়ে কাতার গ্যাস (রাশ গ্যাস) থেকে জি-টু-জি ভিত্তিতে আনা ৩ হাজার ৪০৩ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৩৮৮ দশমিক ৫০ মিলিয়ন টাকা। এতে প্রতি ঘনমিটারের দাম পড়েছে ৪৭.৪২ টাকা। ওমান থেকে জি-টু-জি ভিত্তিতে আনা ১ হাজার ১৯১ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস ৪৪.৫৬ টাকা হারে পড়েছে ৫৩ হাজার ৮০ দশমিক ১৪ মিলিয়ন টাকা। আর স্পর্ট মার্কেট থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে আমদানি করা এলএনজির দাম পড়েছে ৬৫.০৬ টাকা করে। স্পর্ট মার্কেট থেকে আনা ৩ হাজার ৪০৩ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়েছে ২ লাখ ২১ হাজার ৪৪৩ মিলিয়ন টাকা। এলএনজি মুসক (৭.২০ টাকা) রি-গ্যাসিফিকেশন (২.৬৩ টাকা) উৎসে কর (২.৪৭ টাকা), এআইটি (১.০৭ টাকা) যুক্ত হওয়ার পর আমদানিকৃত গ্যাসের দাম পড়েছে ৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৪১ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন টাকা।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশীয় উৎস থেকে মোট গ্যাসের গড় মূল্য পড়েছে ৩.৩৯ টাকা। আমদানিকৃত গ্যাসের গড়মূল্য পড়েছে ৬৮.৭১ টাকার মতো। দেশীয় ৭২.২১ শতাংশ গ্যাসের সঙ্গে আমদানি করা ২৬.৮৯ শতাংশ গ্যাসের মিশ্রিত ক্রয়মূল্য

রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পেট্রোবাংলার আধীনে পরিচালিত একটি বৃহৎ গ্যাস কম্পানি। তরল প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহকারী আরপিজিসিএলের তথ্য, দেশের গ্যাস উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস এবং বিদ্যুৎ, শিল্প-কারখানা ও আবাসিক খাতে চাহিদা বাড়ছে।

এতে এলএনজি আমদানি বর্তমানে দেশের জ্বালানি মিশ্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ৪১ এলএনজি কার্গো (২.৫২৭ মিলিয়ন টন) আমদানি করলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪ কার্গোতে (৫.৮০৮ মিলিয়ন টন)। ২০২৬ সালে এই সংখ্যা আরো বেড়ে ১২৪ থেকে ১২৬ কার্গোতে পৌঁছাতে পারে। এটি দেশে এলএনজির ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার স্পষ্ট ইঙ্গিত।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ১১ হাজার ৮১২ কোটি ৫২ লাখ টাকার এলএনজি আমদানি করা হয়। এই অর্থবছরে ভর্তুকি দেওয়া হয় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৫০২ কোটি ৯৮ লাখ টাকার এলএনজি আমদানি হয়, ভর্তুকি দেওয়া হয় তিন হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৬ হাজার ৫০৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকার এলএনজি আমদানি করা হয়, ভর্তুকি দেওয়া হয় তিন হাজার ৪৯৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪০ হাজার ৫৬২ কোটি ৭৭ লাখ টাকার এলএনজি আমদানি হয়, ভর্তুকি দেওয়া হয় ছয় হাজার কোটি টাকা।

২০২২-২৩ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি করা হয় ৩৫ হাজার ২৭৪ কোটি পাঁচ লাখ টাকার, ভর্তুকি দেওয়া হয় ছয় হাজার ৩৩২ কোটি তিন লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪২ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকার এলএনজি আমদানি করা হয়, ভর্তুকি দেওয়া হয় ছয় হাজার ৩৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি করা হয় ৪০ হাজার ৭৫১ কোটি ৫৮ লাখ টাকার। ওই অর্থবছরে মোট ভর্তুকি দেওয়া হয় আট হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

পেট্রোবাংলার গ্যাস সরবরাহের তথ্য বলছে, গতকাল শনিবার জাতীয় গ্রিডে মোট গ্যাস সরবরাহ করা হয় দুই হাজার ৮৩৯ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে এলএনজি থেকেই সরবরাহ করা হয় এক হাজার ৩৯ মিলিয়ন ঘনফুট। মূলত দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাড়ানো হয়েছে এলএনজির সরবরাহ। এতে সরকারের ভর্তুকিও বাড়ছে। ২০১৮ সালে প্রতি ঘনমিটার আরএলএনজির দাম ছিল ৩৮ টাকা, যা ২০২৫ সালে দাঁড়িয়েছে ৫৬ টাকায়। এর ফলে সরকারকে বাড়তি ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, গত তিন বছরেই দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি কমে গেছে। অন্যদিকে এই সময়ে বিদ্যুৎ ও শিল্প খাতে গ্যাসের ব্যবহার বেড়েছে। ফলে এখন বাড়তি এলএনজি আমাদানি করেও ঘাটতি পূরণ করা যাচ্ছে না।

বাপেক্সেও সূত্রে জানা গেছে , দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০টি নতুন কূপ খননের

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় আমাদানীকৃত এলএনজির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। কিন্তু আমাদের এলএনজি টার্মিনালের সক্ষমতা মাত্র এক হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বর্তমান চাহিদার তুলনায় সীমিত।