ভারত থেকে স্থলপথে আমদানি বন্ধে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে সুতার বাজারে। এর ফলে নুতন করে বিপাকে পড়েছে দেশের শীর্ষ রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত উদ্যোক্তরা। নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্তে তুলনামূলক বেশি খরচে দেশীয় সুতা উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে সুতা কিনতে হবে অথবা ভারত, চীন, তুরস্ক ও উজবেকিস্তান থেকে সমুদ্র পথে সুতা আমদানি করতে হবে। সমুদ্র পথে আমদানিতে আবার সময় লাগে বেশি। তবে ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করায় সুবিধা হয়েছে দেশের বস্ত্রকল মালিকদের। এতে তাদের গুদামে থাকা কয়েক হাজার কোটি টাকার সুতা সহজেই বিক্রি হয়ে যাবে।
নীট শিল্পের সাথে জড়িত কয়েকজন ব্যবসায়ির সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত গার্মেন্টেস শিল্পের সাথে জড়িতরা নুতন করে বিপাকে পড়েছে। নারায়ণগঞ্জে নীট শিল্প মালিক মজিবুর রহমান জানান, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল, কলকারখানায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানান জটিলতায় এক অন্ধকার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের শীর্ষ রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক। এমন দুর্যোগের সময়ে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে করে নতুন করে বিপদে পড়ছেন তৈরি হয়েছে। সুতা আমদানি বন্ধে নতুন বিপদে পোশাক রপ্তানিকারকরা
গার্মেন্টেস মালিক জামাল উদ্দিন বলেন, স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত ‘অপরিপক্ব’ ও ‘ভুল’ এর ফলে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থেকে পিছিয়ে পড়বেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থানীয় সুতা ও ভারত থেকে আমদানি করা সুতার মধ্যে প্রতি কেজিতে দামের পার্থক্য ২০ থেকে ৫০ সেন্ট। এতে পোশাক রপ্তানিকারকরা দেশে উৎপাদিত সুতার চেয়ে ভারত থেকে আমদানি করা সুতার ওপর বেশি উৎসাহী হয়ে উঠেছেন।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) একজন কর্মকতা জানান, ‘আমরা যেটুকু সুতা উৎপাদন করছি তা বিক্রি করতে পারছি না। এলসি ও বিনা এলসিতে ভারত থেকে সুতা আসছে। অন্যদিকে, ভারত যে দামে সুতা বিক্রি করছে তা ডাম্পিং। ফলে আমাদের উৎপাদিত সুতা গুদামে অবিক্রীত পড়ে আছে। বর্তমানে আমাদের সদস্যদের গুদামে আট থেকে দশ হাজার কোটি টাকার সুতা অবিক্রীত পড়ে আছে।’
গত ১৩ এপ্রিল ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে সুতাসহ বেশ কিছু পণ্য স্থলবন্দর দিয়ে আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস উইং। বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে আমদানির সুবিধা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর।
দীর্ঘদিন ধরে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছিল। সংগঠনটির অভিযোগ, দেশীয় পোশাক রপ্তানিকারকরা তাদের সুতা না নেওয়ায় তারা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ভারত উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম দামে বাংলাদেশে সুতা পাঠানোর কারণে দেশের বস্ত্রকলগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এছাড়া স্থলবন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় সুতা আনা হচ্ছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি এনবিআরকে নির্দেশ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পেয়ে এনবিআর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দীর্ঘদিনের দাবি সত্ত্বেও এমন এক সময় এ সিদ্ধান্ত এলো, যখন ভারত তার বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন করে শুল্ক আরোপ এবং দেশের কলকারখানায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে পোশাকখাতের উদ্যোক্তারা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন।করোনা মহামারির পর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সরকার ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে দেশের স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির অনুমতি দেয়।
বিটিএমএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ১২ লাখ ১৫ হাজার টন সুতা আমদানি করেছে, যা ২০২৩ সালের চেয়ে ৩১ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের আমদানি হওয়া সুতার ৯৫ শতাংশ এসেছে ভারত থেকে। গত বছর যে পরিমাণ সুতা আমদানি হয়েছে, তা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
জানতে চাইলে বিটিএমএর পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উৎপাদিত সুতা কলকাতায় গুদামজাত করা হয়। এরপর সেখান থেকে সুতা বাংলাদেশে পাঠানো হয়। এসব সুতা তুলনামূলক কম দামে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এ কারণে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা দেশীয় সুতা ব্যবহার করছে না। বস্ত্র শিল্পকারখানাগুলো বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘এটি একটি অন্যায় সিদ্ধান্ত। সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে। ছোট কারখানাগুলো বেশি বিপদে পড়বে।’
তিনি বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বড় ক্ষতির মুখে পড়বেন। এতদিন রপ্তানি আদেশ পেলে ১০ থেকে ২০ টন সুতা দুদিনের মধ্যে ভারত থেকে আমদানি করা যেতো। এখন উৎপাদনের সময় বেড়ে যাবে।’
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বিটিএমএ অভিযোগ করেছে এক ট্রাকের এলসি করে আমরা তিন ট্রাক সুতা আনি। এটা কখনো সম্ভব নয়। আমাদের কাস্টমস বা ভারতে কাস্টমস কি এতই ইনইফিশিয়েন্ট, যে এটা হচ্ছে? এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের সময় দেওয়ার দরকার ছিল।’
তিনি বলেন, পোশাকশিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ৩০ কাউন্ট সুতার প্রতি কেজি উৎপাদন খরচ এখন ৩ দশমিক ৪০ মার্কিন ডলার। একই সুতা ভারত থেকে আমদানি করলে ২ ডলার ৯০ সেন্ট দাম পড়ে। যে কারণে স্থানীয় মিল থেকে সুতা কেনায় আগ্রহী হন না তারা।
ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানির বিষয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপনের নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এনবিআরের নতুন ব্যাখ্যা অনুসারে, গত ১৩ এপ্রিল বা এর আগে ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানির জন্য যারা ঋণপত্র খুলেছেন, তারা আগের মতো স্থলবন্দর দিয়ে ওই সুতার চালান খালাস করতে পারবেন। এছাড়াও ১৩ এপ্রিল বা এর আগে যারা এই সংক্রান্ত ঋণপত্র সংশোধন করেছেন, তারাও একই সুবিধা পাবেন। ১৬ এপ্রিল এনবিআর এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করে।
গত ১৩ এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপনে বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির সুবিধা বাতিল করে এনবিআর। যারা ১৩ এপ্রিল বা এর আগে ঋণপত্র খুলেছিলেন, তারা কী করবেন-এ নিয়ে মাঠপর্যায়ের অস্পষ্টতা দূর করতে নতুন ব্যাখ্যা দিলো এনবিআরের শুল্ক বিভাগ।
এনবিআরের নতুন আদেশে বলা হয়েছে, যেসব আমদানিকারক ১৩ এপ্রিল বা তার পূর্বে সুতা আমদানির ঋণপত্র খুলেছেন বা ওই তারিখের আগে সুতা আমদানির ঋণপত্র সংশোধন করেছেন, সেসব ঋণপত্রের পণ্য চালান জারি করা প্রজ্ঞাপনের (১৩ এপ্রিলের প্রজ্ঞাপন) আওতায় পড়বে না।
দীর্ঘদিন ধরেই স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধের দাবি করে আসছেন দেশীয় স্পিনিং মিল মালিকেরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিন মাস আগে সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া শুরু করে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে বস্ত্র খাতের অন্যতম কাঁচামাল সুতা আমদানি বন্ধের দাবি জানায় বস্ত্রশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। এরপর গত মার্চ মাসে এক চিঠিতে পোশাকশিল্পে দেশে তৈরি সুতার ব্যবহার বাড়াতে স্থলবন্দর দিয়ে পোশাকশিল্পের সুতা আমদানি বন্ধ করার জন্য এনবিআরকে ব্যবস্থা নিতে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন।
তখন ট্যারিফ কমিশন থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানকে পাঠানো চিঠিতে দেশীয় টেক্সটাইল শিল্পের স্বার্থ সংরক্ষণে সব সীমান্ত সংলগ্ন সড়ক ও রেলপথ এবং স্থলবন্দর ও কাস্টম হাউজের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসারে সুতা কাউন্ট নির্ণয়ে যথাযথ অবকাঠামো প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত আগের মতো সমুদ্রবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির সুপারিশ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করেন।