আজ ১০ জুলাই বৃহস্পতিবার। ২০২৪ সালের এইদিনটি ছিল বুধবার। ১ থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত টানা আন্দোলন চালিয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সরকারের রিএ্যাকশন চোখে পরার মতো ছিল না। তখনো আন্দোলনটা ভিন্ন পথেই দমন করতে চেয়েছিল সরকার। তারা চেয়েছিল কেবল আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কৌশলে আর বিচার বিভাগের মাধ্যমেই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটাবে। কিন্তু না। আশায় ছেদ পরে যখন ক্রমশই উত্তাল হতে থাকে দেশ। তখন মূলত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী বিচার বিভাগের সাথে যুক্ত হয় রাজনৈতিক কৌশল। এজন্য ১০ জুলাই বিচার বিভাগের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রতি উত্তর আসে। মূলত সরকারের তিনটি জায়গা থেকে রেসপন্স আসে। প্রথমত প্রধান বিচারপতি। দ্বিতীয়ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং এটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিনের কাছ থেকে। তাদের প্রত্যেকেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বাদ দিয়ে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান।
ধারাবাহিক আন্দোলনের দশ দিনের মাথায় যে প্রতিক্রিয়া দেখানো হলো তাতে মনে হয় সরকার ছাত্র আন্দোলনকে হিসেবে নিয়েছে। বলতে গেলে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি উত্তর দিয়েছে। এইদিন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে উত্তেজনাকর বক্তব্য এলো। শিক্ষার্থীরা তাতে আঁচ করতে পারলো যে নতুন কোন নির্যাতন আসতে চলেছে। শিক্ষার্থীরাও ততক্ষনে জেনে গেছে সামনে কি হতে চলেছে! সুতরাং শিক্ষার্থীরা সাবধানতার সাথেই আন্দোলনের প্লান করে। প্লানের অংশ হিসেবে প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সেদিন মাঠে নামে। রামপুরা ব্রীজের কাছে সেদিন প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ প্রদর্শণ করে।
সাধারণত প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন নিয়ে মাঠে নামার কথা নয়। কিন্তু এরপরও তারা মাঠে নেমেছে। সমন্বয়কারীদের গোপন প্লানের ভিত্তিতে প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় মাঠে নামে ১০ জুলাই থেকে। এর অর্থ জানা যায় সমন্বয়ক সাদিক আরমানের জবানিতে। তিনি তার বয়ানে বলেন, প্রকৃতপক্ষে আমরা কোটার জন্য রাস্তায় নামিনি। আমরা দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে নেমেছিলাম। ফ্যাসিজমের পতন ঘটাতে রাস্তায় নামি। আমরা কোন আবেগের বশবর্তী হয়ে নামিনি। তিনি বলেন, আমরা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়েও গিয়ে নিরাপত্তা দেওয়ার কাজ করেছি। যখন হল বনধ হয়ে যায় তখন সেখানে আমরা প্রটেকশন দিয়েছি। কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের সাথে প্লান করে রাস্তায় নামা হয় সেদিন।
এদিকে জুলাইয়ের ১০ দিনের আন্দোলন ততক্ষণে আন্দোলন গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা ও বিশ^বিদ্যালয়ের ঐকমত্য পোষণ করে। দেশের মানুষ বুঝতে পারে যে শিক্ষার্থীরা কেবল তাদের না, দেশের ১৮ কোটি মানুষের কথা বলছে। তাই বলা যায় এই কয়দিনে দেশের মানুষের প্রাণের দাবির সাথে ছাত্ররা এক হতে পেরেছে।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের পেছনে যে সরকার পতনের বীজ নিহিত তা সরকার একটু দেড়িতেই বুঝতে পেরেছিল। যখন বুঝতে পারে তখন সরকার অতিরিক্ত বেপরোয় হয়ে যায়। যা হিতে বিপরীত হয় সরকারের জন্য। তখন তারা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রলীগকে মাঠে নামায়। ঢাকা মহানগর থেকে ছাত্রলীগ এবং যুবলীগকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাঠায়। এসব প্রতিটি পদক্ষেপ বুমেরাং হয় সরকারের জন্য। এছাড়া শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে অপমান সূচক বক্তব্য বিশ^বিদ্যালয়গুলোর সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষেপিয়ে তোলে। স্বৈরাচার হাসিনা এবং তার সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের উস্কানিমূলক বক্তব্য আন্দোলনে আগুণে ঘি ঢালার পরিস্থিতিতে নিয়ে যায়।
সরকারের আচরণে বিরক্ত হওয়ার চিহ্ন দেখা গেলে শিক্ষার্থীরা কৌশলে পরিবর্তন আনে। তারা বুঝতে পারে যে নিত্য নতুন কর্মসুচি নতুন নতুন কৌশল না আনা হলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে যেতে পারে।
এদিকে ১০ জুলাই সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ আপিল বিভাগের। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, ‘আমি প্রথম দিনই বলেছিলাম, রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন হয় না। এটা আজকে না, আমি যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ছিলাম, তখন একটি মামলায় বলেছিলাম, রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন করা যায় না। এটি সঠিক পদক্ষেপ না।
জুলাইয়ের ১০ তারিখ বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘আগামীকাল বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে বাংলাদেশের সর্বত্র সড়ক ও রেলপথে শিক্ষার্থীরা বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন। বিকাল সাড়ে ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে আমরা কর্মসূচি শুরু করব এবং শিক্ষার্থীরা সারাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ব্লকেড কর্মসূচি সফলভাবে পালন করবেন। বুধবার সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি সারাদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত রাজধানীর জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ ২৫ টি পয়েন্টে আন্দোলনকারীরা তাদের দাবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্রীয়ভাবে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে কর্মসূচি পালন করে। সেখান থেকে অবরোধ তুলে নেওয়ার আগে শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরির সব গ্রেডে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রেখে কোটাব্যবস্থা যৌক্তিক সংস্কার করে আইন পাসের দাবি জানান। এদিন সকাল ১০টার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে লাইব্রেরি চত্বরে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তারা সেখান থেকে মিছিল করে কোটাবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে শাহবাগসহ বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেন। শাহবাগে আসার পর আন্দোলনের সমন্বয়কদের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে শাহবাগের আশেপাশের সড়কগুলো অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে শাহবাগ মোড়, কারওয়ান বাজার মোড়, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, বাংলামোটর, ফার্মগেট মোড়, শিক্ষা চত্বর, মৎস্য ভবন মোড়, চানখাঁরপুল মোড়, বঙ্গবাজার মোড় অবরোধ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, শেখ বোরহান উদ্দিন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজের শিক্ষার্থীরা।
এদিন বেলা সাড়ে ১১টায় সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। পাশাপাশি পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ৭ আগস্ট দিন ধার্য করা হয়। এক মাসের স্থিতাবস্থার রায়ের পর প্রধান বিচারপতি শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান।
এদিকে দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার সংলগ্ন রেলপথ অবরোধ করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। প্রায় এক ঘণ্টা যাবৎ তাদের অবরোধের কারণে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদেশের সঙ্গে রেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। একইসঙ্গে বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, রিক্সা, ভ্যান ও মোটরসাইকেলসহ সব ধরনের যান চলাচলও বন্ধ করে দেন আন্দোলনকারীরা। গুলিস্থান জিরো পয়েন্ট ও পল্টন মোড়ও অবরোধ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা সকাল ১০টা থেকে গুলিস্তানে নূর হোসেন চত্বর দিয়ে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন।
এছাড়া, রাজধানীর সায়েন্সল্যাব অবরোধ করেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। অপরদিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মহাখালী অংশের সড়ক অবরোধ করেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। রাজশাহী অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরা। সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কসহ সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ময়মনসিংহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রংপুর মডার্ন মোড় অবরোধ করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দেওয়ান হাটসহ চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত কলেজসমূহের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা-পাবনা মহাসড়ক অবরোধ করেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা-দিনাজপুর মহাসড়ক অবরোধ করেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা- ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা-পটুয়াখালী মহাসড়ক অবরোধ করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে বরিশাল বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা।
কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে ১ জুলাই থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বুধবার টানা চতুর্থ দিনের মতো ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে ছাত্র ধর্মঘট পালন করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এদিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। মানুষের দুর্ভোগ হয় এমন কর্মসূচি পরিহার করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
কোটা বাতিল নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিষয়ে আপিল বিভাগের স্থিতাবস্থার পর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘আপিল বিভাগ স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বলেছেন। অর্থাৎ, যেমন আছে, তেমন থাকবে। কোটা বাতিল-সংক্রান্ত ২০১৮ সালের পরিপত্রের ভিত্তিতে যে সব সার্কুলার দেওয়া হয়েছে, সেখানে কোটা থাকছে না। যারা আন্দোলন করছেন, তাদেরকে আমি অনুরোধ করব, যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট এটা বিবেচনায় নিয়েছেন, অতএব এখন (আন্দোলন করার) কোনো যৌক্তিক কারণ নাই। এটি বন্ধ করে তাদের ফিরে যাওয়া উচিত।