জোট মনোনীত প্রার্থীদের প্রতীকের বিষয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) বিধান সংশোধনের বিষয়ে নানামুখী বিতর্ক তৈরী হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী আরপিও’র বেশকিছু সংশোধনী উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত হয়। পরবর্তীতে অধ্যাদেশ জারির আগে একটি রাজনৈতিক দলের দাবির প্রেক্ষিতে জোটগত দলকে ভোটে নিজস্ব প্রতীক ব্যবহার করার বিধান বাতিল করার উদ্যোগ নেয়ায় বিতর্ক তৈরী হয়। উপদেষ্টা পরিষদে পাস হওয়ার পর চুপিসারে তা বাতিল করার কোন সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশনও এ বিষয়ে নিজেরা কোন দায়িত্ব না নিয়ে সরকারের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে। তবে সংস্কার কমিশনের এ প্রস্তাব নিয়ে বিতর্র্ক দেখা দেয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্টরা।
সূত্রমতে, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ২৩ অক্টোবর গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) একগুচ্ছ সংস্কার এনে নীতিগত ও চূড়ান্ত অনমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। এরপর এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও তা অধ্যাদেশ আকারে জারি হয়নি।
আরপিও সংশোধন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনের সচিব আখতার আহমেদ বলেন, উপদেষ্টা পরিষদে এর নীতিগত অনুমোদনের পর বাকি কাজটুকু করে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ডিভিশন। তারা অধ্যাদেশ জারি করেন। কাজেই অধ্যাদেশ জারির বিষয়টি যতক্ষণ না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা অপেক্ষায় আছি।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের এখান থেকে নতুন করে বলার মতো কিছু নেই। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, আইন মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত অবস্থান জানার পরেই এ বিষয়ে কথা বলা যাবে।
আরপিওর একটি সংশোধনীকে কেন্দ্র করে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আপত্তি দেখা গেছে। আরপিওর ২০ অনুচ্ছেদে যে সংশোধনী আনা হয়েছে, তাতে জোটভুক্ত হলেও মনোনীত প্রার্থীকে তার দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে। আগের বিধান অনুযায়ী, নিবন্ধিত দলের জোটের প্রার্থীরা যে কোনো প্রতীকে ভোট করতে পারতেন। প্রধান দলগুলোর প্রতীক জোটভুক্ত ছোট দলের কয়েকজন প্রার্থীর ব্যবহারের সুযোগ ছিল এবং অতীতে তারা জিতেও এসেছেন।
নিবন্ধিত দলের স্বাতন্ত্র, প্রতীকের জনপ্রিয়তাসহ কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রেখে জোটভুক্ত হলেও স্ব স্ব প্রতীকে ভোটের বিধান চালুর সুপারিশ করে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এ সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনও নানা সংস্কার প্রস্তাবে তা অন্তর্ভুক্ত রাখে। সবশেষ উপদেষ্টা পরিষদেরও অনুমোদন পেয়েছে বিষয়টি। কিন্তু বিএনপি আরপিওর ২০ অনুচ্ছেদের সংশোধনী নিয়ে আপত্তি তুলেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন করার পাশাপাশি বিধানটি বাদ দিয়ে আগের অনুচ্ছেদই বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে দলটি। বিএনপির জোটসঙ্গী কয়েকটি দলও ইসিতে চিঠি দিয়েছে, বিক্ষোভ করেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ আইন উপদেষ্টার সঙ্গেও এ নিয়ে বৈঠক করেছেন।
২৮ অক্টোবর আইন উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনার পর তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আগেও আমি বিষয়টি আইন উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন যে এটা তিনি সরকারের নজরে আনবেন। তিনি নিশ্চয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন এবং সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টারা এটা নিয়ে আলোচনা করেছেন। অধ্যাদেশটি কেবিনেটে পাস হওয়ার পর দেখলাম, বিবেচিত হয়নি।
এরপর জামায়াতের পক্ষ থেকে সিইসির সঙ্গে বৈঠক করে সংশোধনী বহাল রাখার দাবি জানানো হয়। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, কোনোভাবেই সংশোধিত বিধান পরিবর্তন করা যাবে না। জোটে ভোট করলেও স্ব স্ব দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে।
জামায়াতের নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অভিযোগ করে বলেন, ‘অগোচরে’ আরপিও সংশোধন করছে উপদেষ্টা পরিষদ, যা একটি দলের কাছে সরকারের ‘নতি স্বীকার’।
উপদেষ্টা পরিষদের সংশোধনের পর নতুন করে আরপিওর ২০ অনুচ্ছেদ নিয়ে দলগুলোর অবস্থানে ‘হতাশা’ প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আব্দুল আলীম বলেন, জোটে ভোট করলেও প্রতীক হবে স্ব স্ব দলের এমন বিধান তারা সুপারিশ করেছেন এবং ঐকমত্য কমিশনে আলোচনার পর নানা সুপারিশের মধ্যে এটাও রেখেছে ইসি। বিধানটি রেখে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন দিয়েছে। অধ্যাদেশ আকারে গেজেট জারি হয়নি। এখন যদি বিধানটি না রাখে, তাহলে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে না। তার মানে এটা এক ধরনের হতাশা।
তিনি বলেন, সবার সাথে আলোচনা করে যে সুপারিশ এসেছে, সেভাবে এগোচ্ছে। এখন এক ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে আরেক রকম যদি হয়ে যায়, সেটা আন-এক্সেপ্টেড, এটা হওয়া উচিত না।
উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত সংশোধিত আরপিও ২০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলো জোট করলেও নিজস্ব দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। আগে জোটবদ্ধ দলগুলোর জোটের প্রতীকে ভোট করার সুযোগ ছিল।
বিএনপিসহ কয়েকটি দল আরপিও এর ২০ অনুচ্ছেদের আগের বিধান বহাল চেয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ ৮ দল সংশোধিত আরপিও বহাল রাখার পক্ষে।
এরইমধ্যে জামায়াতে ইসলামীসহ আটটি দল সিইসির সঙ্গে বৈঠক করে স্মারকলিপিও দিয়েছে। গত রোববার আইন উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। দলের সচিব আখতার হোসেন সেখানে লিখেছেন, “সাম্প্রতিক সময়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ২০ অনুচ্ছেদ সংশোধন সংক্রান্ত আলোচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিকে দেওয়া আপনার ব্যক্তিগত আশ্বাস ও অবস্থান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, একজন উপদেষ্টা হিসেবে আপনি রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ আইন উপদেষ্টা, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নন। নির্বাচনী আইন সংশোধনের মত বিষয়ে কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে এককভাবে আশ্বাস প্রদান করা জুলাই গণঅভুথান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পদের নিরপেক্ষতা ও দায়বদ্ধতার পরিপন্থি।
রোববার এনসিপি প্রতিনিধি দল তাদের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের একটি চিঠি সিইসির কাছে জমা দেন। সেখানে বলা হয়, “আমরা মনে করি, প্রতিটি নিবন্ধিত দলকে তাদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করার যে সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন নিয়েছে তা একটি ঐতিহাসিক ও নীতিগতভাবে সঠিক পদক্ষেপ। পরবর্তীতে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আরপিওর সংশোধনীর মাধ্যমে উক্ত বিধান অনুমোদিত হয়েছে এবং শুধুমাত্র গেজেট প্রকাশ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে এখন সরকার বা নির্বাচন কমিশন যদি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির রাজনৈতিক চাপে পাস হওয়া সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার মাধ্যমে সরকার তার অবস্থান পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়, সেক্ষেত্রে শুধু কমিশনের স্বাধীনতার ওপরই আঘাত নয়, বরং পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা এবং সরকারের কার্যক্রমের ওপরও আঘাত।
এদিকে গতকাল সোমবার ১২টি দলের পক্ষ থেকে সংশোধনী বাতিল করার দাবিতে নির্বাচন কমিশনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে।
জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মহাসচিব আহসান হাবীব লিখিত দাবিটি ১২ দলের পক্ষে সিইসির দপ্তরে জমা দেন। অন্য দলগুলো হলো-লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, জাতীয় দল বাংলাদেশ জমিয়াতে উলামায়ে ইসলাম, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, নয়া গণতান্ত্রিক পার্টি, ইসলামিক পার্টি, প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দল ও ইউনাইটেড লিবারেল পার্টি।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলেও শরিক দলগুলোকে নিজ নিজ দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে হবে-গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) এমন সংশোধনীতে ১২ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে আমরা আপত্তি জানাচ্ছি। এই পরিবর্তন আমাদের কাছে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আরপিও সংশোধনীর অনুচ্ছেদ-২০-এ জোটগত নির্বাচন বিষয়ে বলা হয়েছে, জোট মনোনীত প্রার্থী হলেও তাকে নিজের দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। আমরা এ পরিবর্তনের তীব্র বিরোধিতা করছি। অতীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জোটবদ্ধ হয়ে নিজেদের বা জোটের অন্য কোনো দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এটা রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার।
এই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন অনুষ্ঠানে এর আগে কোনো সমস্যা হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত এই প্রক্রিয়া পরিবর্তনের কোনো দাবি ছিল না। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে আলোচনাকালে আরপিওর ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে কোনো পরিবর্তন আনা হবে না বলে বিএনপিসহ আমাদেরকে আশ্ব¯ করা হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই পত্রিকায় খবর এল যে জোট করলেও দলীয় প্রতীকে ভোট করতে হবে।
জোট গঠনের মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনে জয়ী হওয়া এমন যুক্তি তুলে ধরে চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, জোটবদ্ধ দলগুলোর পছন্দ অনুযায়ী প্রতীক চাওয়ার অধিকার আছে। এভাবেই এত দিন প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং এতে কোনো সমস্যা হয়নি। এই প্রচলিত পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিল, তা আমাদের বোধগম্য নয়। এছাড়া নির্বাচনের প্রধান অংশীজন অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা ছাড়াই এমন একটি বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনভিপ্রেত এবং আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। ১২ দলীয় জোট মনে করে, আরপিওর এই সংশোধনী রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে।...তাই আমরা আরপিওতে ২০ অনুচ্ছেদের পূর্বের বিধান বহাল রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। সংস্কারের দোহাই দিয়ে ভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে না।