ঐতিহাসিক জুলাই মাসের দ্বিতীয় দিন আজ বুধবার। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামের প্লাটফর্ম গঠন হলে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নড়েচড়ে বসে। শেখ হাসিনার কাছে খবর পৌঁছানো শুরু করে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এদের ওপর খড়গ হস্ত হয়ে উঠে। ছাত্ররা বিষয়টি বুঝতে পেরে আন্দোলনের কৌশল বদল শুরু করে। আন্দোলনের স্থানও বদলাতে থাকে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশেই। কখনো রাজু ভাষ্কর্য্যরে সামনে, কখনো কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর সামনে আবার কখনো শাহবাগে যাদুঘরের সামনে। এভাবেই আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বড় হতে থাকে। সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ তাদের দাবিগুলোর যৌক্তিকতার পক্ষে সমর্থন দিতে থাকে।

২০২৪ সালের ২ জুলাই শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করে এবং বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে আন্দোলনকারীরা মূল সড়ক ছেড়ে দেন। পরে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। সেই দিন বিক্ষোভ মিছিলে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘এটা শুধু শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের আন্দোলন নয়। এটা একটা রাষ্ট্রের বিষয়। মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এক জিনিস নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোনো বংশ পরম্পরার বিষয় নয়, এটা একটা রাষ্ট্রীয় আদর্শ। এই আদর্শকে আমরা তরুণেরা ধারণ করি। সে জন্যই আমরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছি। নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন, আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও পরীক্ষা বর্জন চলবে। একই দিন বিকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন।

স্বৈরাচার হাসিনার ভক্ত কুলাঙ্গার পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা কর্মচারী যখন গণতন্ত্রকামীদের ওপর খড়গ হস্ত ছিল; জেল, জুলুম আর হত্যাকাণ্ডের শিকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে যখন রাজনীতিবিদেরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। আন্দোলনের সমস্ত অস্ত্র যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছিল। মনে করা হচ্ছিল যে হাসিনা যতদিন জীবিত ততদিন মুক্তি নাই। তখন ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান নিয়ে সামনে আসে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন।

এ্ই আন্দোলনে প্রথমেই ভেস্তে যায় হাসিনা আর তার দলের চেতনার ব্যবসা। যে স্লোগানি দিয়ে সারা দেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখতো সেই স্লোগান দেশের ১৮ কোটি মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয় ভিন্নভাবে। তারা বুঝতে পারে হাসিনার চেতনার ব্যবসার অন্য উদ্দেশ্য আছে। এই স্লোগানের অন্তরালে আছে নিগুঢ় রহস্য। তার ঘাড়ে বসে আছে আধিপত্যবাদের কালো শকুন। তাইতো সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে তার নিন্দাবাদের স্লোগান ওঠে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’, অথবা ‘চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘লাখো শহিদের রক্তে কেনা, দেশটা কারো বাপের না’।

মূলত ঘটনার সূত্রপাত ২০২৪ সালের ৫ জুন সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। ওই দিনই রায় প্রত্যাখ্যান করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর ৯ জুন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে আবারও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি মানতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। এ সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দেন তারা। একই দাবিতে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেন।

প্রকৃত অর্থে এই আন্দোলন সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে শুরু হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ এই পদ্ধতির কারণে বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল, কারণ কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধাভোগী গোষ্ঠী বা অঞ্চলের জন্য সংরক্ষিত আসনের কারণে অন্যান্য যোগ্য প্রার্থীরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুতই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং এতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা অংশ নেয়। এটি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং জাতীয় পর্যায়ে একটি বড় আন্দোলনে রূপ নেয়।

এদিন তিন দিনের কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচীর মধ্যে ছিল ৩ ও ৪ জুলাই রাজধানীর রাজু ভাস্কর্যে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত সরকারি কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সমাবেশ। সমাবেশে নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন- ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন চলবে। সেই সঙ্গে তিনি চারটি দাবি উত্থাপন করেন - ১. দ্রুত কোটা সংস্কারে কমিশন গঠন, যেন পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়। ২. কোটা পূরণ না হলে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা। ৩. নিয়োগে একাধিকবার কোটা সুবিধা ব্যবহার বন্ধ করা। ৪. প্রশাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।