দেশের এই ক্লান্তিলগ্নে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ অনেকটাই বন্ধ। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ আমলের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে গতিশীল করতে গেল বছরের ডিসেম্বরে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে বেশ কিছু নির্দেশনাও দিয়েছে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তী সরকার। সেখানে একেবারেই প্রয়োজন না হলে বিদেশ সফরের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের এই আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ২৯ জনের একটি প্রমোদ ভ্রমণের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজম্যান্ট (বিআইএম)। চার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে দুই গ্রুপে অস্ট্রেলিয়ায় এই প্রমোদ ভ্রমণের অনুমতি দিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ে ইতিমধ্যে আবেদনও পাঠানো হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ভুয়া কাগজে ও নাম স্বর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের পরিচয় ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ গ্রহণের নামে এই প্রমোদ ভ্রমণের আয়োজন চলছে। মহান স্বাধীনতার ঘোষক এবং আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে লিখিত ডকুমেন্টেস এ ‘নব্য রাজাকার’ আখ্যা দেয়া বিআইএম এর বিতর্কিত কর্মকর্তা, দ্বৈত নাগরিক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাজমী নেওয়াজ নিজেকে পুনর্বাসনের পাশাপাশি বিশেষ সুবিধা নিতেই এতো আয়োজন করে। প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তাদের ভূয়া কাগজপত্র দেখিয়ে তিনি এই উদ্যোগ নেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রমতে, গত ২৯ জুলাই বিআইএম এর মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব ড. খন্দকার আজিজুল ইসলাম সাক্ষরিত এক চিঠিতে (স্মারক নং-৩৬.০৭.০০০০.০০৫.২৪.৪৯৪.২৫/১৩৫৯) অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এবং গাম্মা কলেজ এর যৌথ আয়োজনে ‘এসডিএস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাসটেইনেবিলিটি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রশিক্ষণে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট এর ২৫ জন ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের ৪ জন কর্মকর্তাসহ ২৯ জনের অংশগ্রহণের জন্য ১ম ব্যাচ আগস্ট ১৯ থেকে সেপ্টেম্বর-০৩ এবং ২য় ব্যাচ আগস্ট ২৬ থেকে সেপ্টেম্বর-১০ মেয়াদকালে বহি: বাংলাদেশে ভ্রমণের অনুমোদনের প্রস্তাব শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর উপস্থাপন করেন। এতে বলা হয়, অস্ট্রেলিয়ার দুটি প্রতিষ্ঠান তাদের এই প্রশিক্ষণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। প্রস্তাবিত প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিআইএম এর কর্মকর্তাদের সক্ষমতা ও বিষয় ভিত্তিক জ্ঞানের বিস্তার হবে এবং দেশের শিল্প ও শিল্পের টেকসই নিশ্চিৎ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, বিমান ভাড়া, আবাসন, খাবার খরচ বিআইএম বহন করবে। তবে প্রশিক্ষণ গ্রহণে সরকারকে কোনো টাকা দিতে হবে না। সার্বিক বিবেচনায় এই ২৯ জনকে বহি: বাংলাদেশ ভ্রমণের জন্য সরকারি আদেশ প্রদান করা যেতে পারে বলে আবেদন জানানো হয়।
হিসেব করে জানা গেছে, জনপ্রতি বিমান ভাড়া প্রায় ২০০০ ডলার ৩০ জনের ৬০,০০০ ডলার সমপরিমান টাকা ৭৫,০০০০০/, জনপ্রতি পকেট মানি প্রায় ৬,০০,০০০ টাকা হারে ৩০ জনের ১৮০,০০,০০০/, এবং প্রোগ্রাম অন্যান্য ব্যয় প্রায় ৪০০০০ ডলার সমপরিমান প্রায় ৫৫,০০,০০০/- ফিল্ড ভিজিট বাবদ জন প্রতি ১০০০ ডলার ৩০ জনের ৬০,০০০ ডলার সমপরিমান টাকা ৭৫,০০০০০/, হেলথ ইনস্ওিরেন্স বাবদ, ট্রানজিট, টার্নালভাতা সব মিলেয়ে ৪ কোটি টাকার অধিক অর্থ দেশের এই ক্লান্তিলগ্নে সফরে ব্যয় হবে।
বিশাল এই অর্থ ব্যয়ে যারা এই সফরে যাবার তালিকায় রয়েছেন তাদের মধ্যে প্রথম গ্রুপের ১৪ জনের দুইজন থাকবেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের। তালিকায় তাদের পরিচয় কর্মকতা-১ ও কর্মকর্তা-২ লিখা হয়েছে। অন্যরা হলেন, বিআইএম এর কর্মকর্তা আখুন্দ আহাম্মদ শামসুল আলম, মো: মেহবুব হাসান কল্লোল, মোহাম্মদ নাজমী নেওয়াজ, মুহাম্মদ মইনুল ইসলাম, মোহাম্মদ সাইদুর রহমান, আমিনুর, মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির, মো: রাজিবুল হক, আকলিমা জামান, মো: হাসান আলী, মো: নাজমুস সাকিব ও জাকিয়া রহমান। এছাড়া দ্বিতীয় গ্রুপে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দুইজন ছাড়া বিআইমএর কর্তারা হলেন, প্রকৌশলী মো: তরিকুল ইসলাম, এস এম আর=রিফুল ইসলাম, ড. প্রকৌশলী মামুনুনর রশীদ, ড. উত্তম কুমার দত্ত, আমিনুল ইসলাম, ফারখুন্দা ডরিন, তানভীর হোসাইন, মো: জাফর আলী, নির্ঝর মজুমদার, শেখ সজিবুর রহমান, মামুন মুজতাবা, মো: রবিউল ইসলাম খান ও অমিত দাস।
জানা গেছে, সরকারী তহবিল হতে বিশাল অর্থ ব্যয় করে অস্ট্রেলিয়াতে ভ্রমণ শুধুমাত্র দ্বৈত নাগরিক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাজমী নেওয়াজকে পুনর্বাসনের জন্য এত আয়োজন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিৎ করেছে। জানা গেছে, কিছুদিনের মধ্যে তিনি যদি অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ করতে না পারেন, তাহলে তিনি পরবর্তীতে বড় ধরনের সমস্যায় পড়ে যাবেন। তাই এক ঢিলে দুই পাখি মারাই তার উদ্দেশ্য।
সূত্রমতে, এই নাজমী নেওয়াজ ২০২৪ সালের ২৭ মার্চ বিআইএম এর অফিসিয়াল গ্রুপে মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নব্য রাজাকার বলে উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনাকে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন। এছাড়া জামায়াতের সাবেক আমীর ও শিল্প মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^র চন্দ্র রায়ের আদর্শে থাকাদের ধ্বংস অনিবার্য বলে মন্তব্য করেন।
অভিযোগ উঠেছে, প্রমোদ ভ্রমণের জন্য যেসব কাগজপত্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হযেছে সেগুলো ভুয়া। সেখানে গাম্মা কলেজের প্যাড ব্যবহার করা হলেও আমন্ত্রণকারী ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এর একাডেমিক ম্যানেজার জেমস মেটক্যালফ। এই আমন্ত্রণপত্র কখন পাঠানো হয়েছে তার কোনো তারিখ উল্লেখ নেই। এছাড়া এসডিজি এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাসেটেইনেবিলিটি ইন বংলাদেশ পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, গাম্মা কলেজ অস্ট্রেলিয়া শুধুমাত্র ভোকেশনাল এডুকেশন সংক্রান্ত প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করে। গাম্মা কলেজ অস্ট্রেলিয়া এর সাথে বিআইএম এর কার্যক্রমের সাথে কোনরকম সাদৃশ্য নেই।
বিআইএম এ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাজমী নেওয়াজ বিআইএম এর গবেষণা-প্রকাশনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও এক ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শিল্প সচিবের ক্ষমতা বলে এই প্রমোদ ভ্রমনের আয়োজন করেন।
বিষয়টি নিয়ে শিল্প সচিবের দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্চুক এক কর্মকতা বলেন, নাজমী নেওয়াজ শিল্প সচিবকে বার বার জোর পূবক এই আদেশ করার জন্য অনুপ্রানিত করেন। প্রায় ৬/৭ মাস ধরে বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করে অষ্ট্রেলিয়ায় গমনের প্রস্তাব প্রেরণ করেন। বিশেষ করে গত ০৫ ই আগষ্ট ২০২৪ হতে এই গ্রুপটি আরো বেশে সক্রিয় হয়ে উঠে অস্ট্রেলিয়াতে গমনের জন্য।
সরকার যখন এই মুহূর্তে বিদেশ ভ্রমণে অনেকটা নিষেধ করছে, সেই সময়ে বিশাল অংকের অর্থ ব্যয়ে প্রশিক্ষণের নামে অস্ট্রেলিয়া সফর কিভাবে দেখছেন জানতে চাইলে বিআইএম এর মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব ড. খন্দকার আজিজুল ইসলাম দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, এটা আপনি আমাকে প্রশ্ন করছেন কেন? মন্ত্রণালয়ে জিজ্ঞাসা করুন। এক পর্যায়ে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, আমরা আবেদন করেছি, এখন সেটি অনুমোদন হলে হবে, না হলে হবে না। তিনি বলেন, আসলে আমি দেড় মাস হলো এখানে জয়েন করেছি। আমি এর কিছু জানি না। কারা যাচ্ছে, কখন যাচ্ছে। আমার কাছে ফাইল এনে দিয়েছে, আমি স্বাক্ষর করে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমন্ত্রণের কাগজপত্র পর্যালোচনা করেছেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এসব দেখার সুযোগ আমার হয়নি। নাজমী নেওয়াজের বক্তব্যসহ অন্যান্য বিষয়গুলো তিনি খতিয়ে দেখবেন বলে এ প্রতিবেদককে জানান।
অস্ট্রেলিয়া সফরের আবেদনের বিষয়ে এ প্রতিবেদকের কথা হয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (বৈদিশিক প্রশিক্ষণ ও এনপিও) শামীম সুলতানার সাথে। তিনি বলেন, হ্যা, বিআইএম থেকে অস্ট্রেলিয়ায় প্রশিক্ষণের জন্য অনুমতি প্রদানে একটি আবেদন এসেছে। সেটি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, এখন তো সীমিত পরিসরে সরকার অনুমতি দিচ্ছে। আমরা সার্বিক বিষয় দেখে সিদ্ধান্ত জানাবো। অস্ট্রেলিয়া সফরের বিষয়টি কাউকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের উদ্যোগ কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি আমার জানা নেই। নাজমী নেওয়াজের বিষয়টির বিষয়ে তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানসহ যাদের নাম বলছেন, তাদের বিরুদ্ধে যেটা লিখেছে সেটি বড় অপরাধ। তবে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। আপনারা তথ্যগুলো দেন, আমরা তদন্ত করে দেখবো। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সার্বিক বিষয়ে মন্তব্য নিতে শিল্প সচিব মো: ওবায়দুর রহমানের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেন নি।