জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের প্রস্তাব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনাসত্ত্বেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একমতে পৌঁছাতে পারেনি বলে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এ দুটি বিষয় আগেও একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। কিছু প্রাথমিক সমর্থন মিললেও পদ্ধতিগত মতানৈক্যের কারণে ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। গতকাল সোমবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ১৩তম দিনের আলোচনা শেষে এ তথ্য জানান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। সংসদে নারী আসন নিয়ে ঐকমত্য কমিশন আজ নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছে। তাতে বলা হয়, জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বিলুপ্ত হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেসব দল ন্যূনতম ২৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে সেসব দল তাদের মোট প্রার্থীর মধ্যে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারী প্রার্থিতা নিশ্চিত করবে। এ জন্য সংবিধানের এসংক্রান্ত বিধান ৬৫ অনুচ্ছেদে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে।

এর আগে নারী আসনে নির্বাচনের বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের আলাদা দুটি প্রস্তাব ছিল। দুই কমিশনই সংরক্ষিত নারী আসন ১০০টিতে উন্নীত করা এবং সরাসরি ভোটের প্রস্তাব করেছিল। সংবিধান সংস্কার কমিশন বলেছিল, নির্ধারিত ১০০টি নির্বাচনী এলাকা থেকে কেবল নারী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে নারী সদস্যরা সরাসরি নির্বাচিত হবেন। অন্যদিকে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ‘ঘূর্ণমান পদ্ধতি’তে নারী আসনে সরাসরি ভোটের প্রস্তাব করেছিল। নারী আসন ১০০টিতে উন্নীত করার বিষয়ে বেশির ভাগ দল একমত হলেও নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে আপত্তি আছে দলগুলোর। এর ফলে নতুন প্রস্তাবটি (এক-তৃতীয়াংশ প্রার্থী) উত্থাপন করে ঐকমত্য কমিশন। তবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে কেউ কেউ আলোচনায় বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে ২০০৮ সালে আইন করা হয়েছিল। কিন্তু দলগুলো নির্ধারিত সময়ে তা পূরণ করতে পারেনি। নির্বাচনে একতৃতীয়াংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার মতো বাস্তবতা এখনো তৈরি হয়নি। বিএনপি নারী আসন বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের নতুন প্রস্তাব নিয়ে কোনো মত দেয়নি। এ দলটি আগেই তাদের অবস্থান জানিয়ে রেখেছে। সেটা হলো, সংরক্ষিত নারী আসন ১০০টিতে উন্নীত করতে হবে এবং আগের মতো করে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত আসনসংখ্যার ভিত্তিতে দলগুলোর মধ্যে এসব আসন বিতরণ করতে হবে। নতুন প্রস্তাব নিয়ে জামায়াতে ইসলামী বলেছে, এই প্রস্তাবে তাদের দ্বিমত আছে। তারা পিআর (সংখ্যানুপাতিক) পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সংসদীয় আসন মোট ৪০০টি এবং এর মধ্যে ১০০টি নারী আসনের বিষয়ে একমত। আর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নতুন একটি প্রস্তাব দিয়েছে। দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন প্রস্তাবটি তুলে ধরে বলেন, দলগুলোর মোট প্রার্থীর ১০/১৫ শতাংশ নারী মনোনয়ন দিতে হবে। তাতে মোট ৩৫০ -৪০০ নারী প্রার্থী পাওয়া যাবে। যাঁরা নির্বাচনে জয়ী হবেন তাঁরা সংসদ সদস্য হবেন। আর যেসব নারী প্রার্থী হেরে যাবেন তাঁদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া ১০০ জন হবেন সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য।

সংলাপে দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয় ছিল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন। কমিশনের প্রস্তাব, নিম্নকক্ষে ৪০০ আসনের পাশাপাশি উচ্চকক্ষে ১০০টি আসন থাকবে। এই প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আগ্রহ দেখালেও উচ্চকক্ষে সদস্য মনোনয়নের পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ কাটেনি। বিএনপিসহ কয়েকটি দল চায়, দলীয় আসনসংখ্যার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হোক। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ সমমনা দলগুলো জাতীয় নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের আলোকে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন চায়। ঐকমত্য কমিশনও এই পদ্ধতির পক্ষে, তবে এখানেও এখনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা চাই আলোচনা অব্যাহত থাকুক যাতে একটি গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় পৌঁছাতে পারি।’ তিনি জানান, নারী প্রতিনিধিত্ব ও উচ্চকক্ষ নিয়ে আলোচনা শেষ না হওয়ায় আগামীকালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংক্রান্ত সংলাপ স্থগিত রাখা হয়েছে। তবে কিছু দল ইতিমধ্যে লিখিত প্রস্তাব জমা দিয়েছে, যেগুলো নিয়ে বুধ বা বৃহস্পতিবার আলাদাভাবে আলোচনা হবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আমাদের এখনো বিশ্বাস আছে, জুলাই মাসের মধ্যেই একটি জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে, যাতে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে।’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় এই সংলাপ সফলভাবে সম্পন্ন হবে এবং একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় কাঠামো গড়ে উঠবে।

আলোচনায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলনসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) মনির হায়দারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আলী রীয়াজ ছাড়াও কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া অংশ নেন।

আলোচনা শেষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, উচ্চকক্ষ গঠনে আনুপাতিক পদ্ধতি চায় তার দল। তবে তা হতে হবে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে। আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন তিনি। ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘দুই-তৃতীয়াংশ দল উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে একমত হয়। জামায়াতও একপক্ষে। আর সেখানে ৬৪ জেলা ও ১২টি সিটি করপোরেশন থেকে একজন করে উচ্চ কক্ষে আনার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনারই সুযোগ নেই।’ অর্ধেক আলাচনার পর নতুন প্রস্তাব আনাকে বিভ্রান্তিকর বলেও তিনি আখ্যায়িত করেন। অপরদিকে নারী আসন ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়েও জামায়াত একমত বলে জানান ডা. তাহের। তবে তাও হতে হবে ভোটের পদ্ধতি অনুযায়ী। পিআর পদ্ধতিতে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। ব্রিফিংয়ে আরও উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ।