জুলাই আন্দোলন ও অভ্যূত্থানে রাস্তায় গুলীর মুখে দাঁড়িয়ে যে সাহসিকতা ও নেতৃত্ব নারীরা দেখিয়েছে, তা আমাদের ইতিহাসে বিরল নয়Ñবরং গৌরবময় ধারাবাহিকতারই অংশ --- সিনথিয়া জাহীন আয়েশা

সিনথিয়া জাহীন আয়েশা, মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কেন্দ্রীয় কমিটির। তিনি ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দায়িত্ব পালন করেছেন সম্মুখ সারিতে থেকে। তিনি জুলাই আেেন্দালনে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে শুরু করে স্বৈরাচার পতনের পর এক বছরের মূল্যায়ন করেছেন দৈনিক সংগ্রামের সাথে।

প্রশ্ন : বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সাথে কিভাবে যুক্ত হয়েছিলেন জানতে চাই।

সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে আমার সংযুক্তি শুধুমাত্র কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি ছিল বিবেকের দায় থেকে জন্ম নেওয়া এক ঐতিহাসিক চেতনার প্রকাশ। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে যখন রাষ্ট্রের সকল স্তরে বৈষম্য, দমন-পীড়ন ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ রাস্তায় নামে, তখন আমিও দেশের প্রতিটি প্রান্তের নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কণ্ঠস্বর হয়ে উঠার সংকল্প নিই। এটি একটি আত্মিক আহ্বান ছিলÑসংগ্রাম, সংহতি ও সাম্যের পক্ষে দাঁড়াবার। সেইজন্য আমি আন্দোলনে শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করি।

প্রশ্ন : আন্দোলনে নারীর ভূমিকা এবং আন্দোলন পরবর্তী সময়ে নারীর মূল্যায়ন করবেন কিভাবে?

সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে নারীদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী ও অনন্য। রাস্তায় গুলীর মুখে দাঁড়িয়ে যে সাহসিকতা ও নেতৃত্ব নারীরা দেখিয়েছে, তা আমাদের ইতিহাসে বিরল নয়Ñবরং গৌরবময় ধারাবাহিকতারই অংশ। নারীরা শুধু শ্লোগান দেয়নি, তারা প্রথম সারিতে থেকে রাস্তা দখল করেছে, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরিচালনা করেছে, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দিয়েছে। তবে আন্দোলন পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পাই, সামাজিক স্বীকৃতিতে এখনো নারীরা উপেক্ষিত। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যে সমতা আমরা চাই, তা এখনও আসেনি। এই প্রশ্নে আমাদের আত্মসমালোচনা জরুরি। নেতৃত্বের কাঠামোয় নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁদের ভূমিকা আরও জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করা আমাদের চলমান সংগ্রামের অপরিহার্য অংশ।

প্রশ্ন : এক বছরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি কতটুকু?

সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : গত এক বছর ছিল পরীক্ষা, প্রত্যয় ও পরিবর্তনের সময়। আমরা স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়েছি, দমননীতি প্রতিহত করেছি, এবং সমতা ও মানবিক মর্যাদার পক্ষে একটি নবীন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছি। তবে সত্য কথা বলতে, প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি সীমিত হলেও নিরর্থক নয়। আমরা কাঠামোগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে সক্ষম হয়েছি, এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে গণতান্ত্রিক সংবেদনশীলতার দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। এই পথ দীর্ঘÑকিন্তু আমরা জানি, বীজ বপনের সময় ফলের প্রতীক্ষা জরুরি। আমাদের সংগ্রামের এক বছর হলো ভিত্তি নির্মাণের বছর।

প্রশ্ন : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আগামীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি ?

সিনথিয়া জাহীন আয়েশা : আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেÑজুলাইয়ের ঘোষণাপত্র, আহত শহীদ পরিবারদের পুনর্বাসন, জুলাইকে পুনর্জীবিত করা, বৈষম্যবিরোধী নীতি প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে সাম্য নিশ্চিতকরণ এবং প্রগতিশীল ও জনভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের রূপরেখা প্রণয়ন। আমরা চাই এমন একটি সমাজ, যেখানে জন্মের সূত্রে কেউ বঞ্চিত হবে না, ভাষা, ধর্ম, জাতি কিংবা লিঙ্গের কারণে কেউ পেছনে না পড়ে যায়। অতএব, আমরা একটি বিকেন্দ্রীকৃত, অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে চাইÑযা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রামের পাঠশালা পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।

আমরা জুলাইয়ের আহত শহীদ পরিবারদেরকে নিয়ে কাজ করতে চাই, অধিকারগুলোর ক্ষেত্রে তাদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে চাই। জুলাইয়ের আহত, শহীদদের আশা আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে আমরা বদ্ধপরিকর আছি। আমরা কেবল দাবি তুলে ধরা নয়, বিকল্প প্রস্তাব ও বাস্তবসম্মত নীতিনির্ধারণের কাজেও সক্রিয় হবো। এই আন্দোলন এখন আর কেবল ছাত্রদের নয়Ñএটি এখন জনগণের। আর জনগণের মধ্যেই আমাদের ভবিষ্যৎ নিহিত।