বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজম্যান্ট (বিআইএম) এর কর্মকর্তাদের অস্ট্রেলিয়ায় প্রমোদ ভ্রমণ বাতিল করা হয়েছে। গতকাল রোববার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব এ প্রতিবেদককে জানান, সম্প্রতি দৈনিক সংগ্রামে ২৯ জনের বিশাল বহর নিয়ে বিআইমএ’র কর্মকর্তাদের অস্ট্রেলিয়া সফর নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পরই মন্ত্রণালয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, যেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশ ভ্রমণে এই মুহুর্তে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, সেখানে এই ধরণের আবেদন কিভাবে আসে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কাদের ইন্ধনে, বা কাউকে খুশি করার জন্য এটি করা হয়েছে কি-না সেটি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবারই শিল্প উপদেষ্টা বিআইএম’র প্রমোদ সফরের আবেদনটি বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আবেদনটির সাথে যে আমন্ত্রণপত্র দেয়া হয়েছে, সেটি নিয়ে যে সন্দেহ-সংশয়ের অভিযাগ উঠেছে সেটিও খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন।

গত ১৪ আগস্ট দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় ‘সরকারের আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় প্রমোদ ভ্রমণের আয়োজন বিআইএম’র : সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাজমী নেওয়াজকে সুবিধা দিতেই এতো আয়োজন’ শীর্ষক একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদ আমলের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে গতিশীল করতে গেল বছরের ডিসেম্বরে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরে বেশ কিছু নির্দেশনাও দিয়েছে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তী সরকার। কিন্তু সরকারের এই আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ২৯ জনের একটি দলে ভ্রমণের আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজম্যান্ট (বিআইএম)। চার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে দুই গ্রুপে অস্ট্রেলিয়ায় এই প্রমোদ ভ্রমণের অনুমতি নিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ে ইতিমধ্যে আবেদনও পাঠানো হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ভূয়া কাগজে ও নাম স্বর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের পরিচয় ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ গ্রহণের নামে এই প্রমোদ ভ্রমণের আয়োজন চলছে। মহান স্বাধীনতার ঘোষক এবং আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে লিখিত ডকুমেন্টেস এ ‘নব্য রাজাকার’ আখ্যা দেয়া বিআইএম এর বিতর্কিত কর্মকর্তা, দ্বৈত নাগরিক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাজমী নেওয়াজ নিজেকে পুনর্বাসনের পাশাপাশি বিশেষ সুবিধা নিতেই এতো আয়োজন করেন। প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তাদের ভূয়া কাগজপত্র দেখিয়ে তিনি এই উদ্যোগ নেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

গত ২৯ জুলাই বিআইএম এর মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব ড. খন্দকার আজিজুল ইসলাম সাক্ষরিত এক চিঠিতে (স্মারক নং-৩৬.০৭.০০০০.০০৫.২৪.৪৯৪.২৫/১৩৫৯) অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এবং গাম্মা কলেজ এর যৌথ আয়োজনে ‘এসডিএস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাসটেইনেবিলিটি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রশিক্ষণে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট এর ২৫ জন ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের ৪ জন কর্মকর্তাসহ ২৯ জনের অংশগ্রহণের জন্য ১ম ব্যাচ আগস্ট ১৯ থেকে সেপ্টেম্বর-০৩ এবং ২য় ব্যাচ আগস্ট ২৬ থেকে সেপ্টেম্বর-১০ মেয়াদকালে বহি: বাংলাদেশে ভ্রমণের অনুমোদনের প্রস্তাব শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর উপস্থাপন করেন’।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘জনপ্রতি বিমান ভাড়া প্রায় ২০০০ ডলার ৩০ জনের ৬০,০০০ ডলার সমপরিমান টাকা ৭৫,০০০০০/, জনপ্রতি পকেট মানি প্রায় ৬,০০,০০০ টাকা হারে ৩০ জনের ১৮০,০০,০০০/, এবং অন্যান্য ব্যয় প্রায় ৪০০০০ ডলার সমপরিমান প্রায় ৫৫,০০,০০০/- ফিল্ড ভিজিট বাবদ জন প্রতি ১০০০ ডলার ৩০ জনের ৬০,০০০ ডলার সমপরিমাণ টাকা ৭৫,০০০০০/, হেলথ ইনসিওরেন্স বাবদ, ট্রানজিট, টার্নালভাতা সব মিলেয়ে ৪ কোটি টাকার অধিক অর্থ দেশের এই ক্লান্তিলগ্নে প্রমোদ সফরে ব্যয় হবে। সরকারী তহবিল হতে বিশাল অর্থ ব্যয় করে অস্ট্রেলিয়াতে প্রমোদ ভ্রমণ শুধুমাত্র দ্বৈত নাগরিক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাজমী নেওয়াজকে পুনর্বাসনের জন্য এত আয়োজন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। জানা গেছে, কিছুদিনের মধ্যে তিনি যদি অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ করতে না পারেন, তাহলে তিনি পরবর্তীতে বড় ধরণের সমস্যায় পড়ে যাবেন। তাই এক ঢিলে দুই পাখি মারাই তার উদ্দেশ্য’।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রমোদ ভ্রমণের জন্য যেসব কাগজপত্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হযেছে সেগুলো ভুয়া। সেখানে গাম্মা কলেজের প্যাড ব্যবহার করা হলেও আমন্ত্রণকারী ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট অব বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এর একাডেমিক ম্যানেজার জেমস মেটক্যালফ। এই আমন্ত্রণপত্র কখন পাঠানো হয়েছে তার কোনো তারিখ উল্লেখ নেই। এছাড়া গাম্মা কলেজ অস্ট্রেলিয়া শুধুমাত্র ভোকেশনাল এডুকেশন সংক্রান্ত প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করে। গাম্মা কলেজ অস্ট্রেলিয়া এর সাথে বিআইএম এর কার্যক্রমের সাথে কোনরকম সাদৃশ্য নেই।

বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে বিআইএম এর মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব ড. খন্দকার আজিজুল ইসলাম দৈনিক সংগ্রামকে বলেছিলেন, তিনি মাত্র দেড় মাস হলো এখানে জয়েন করেছেন। তিনি বিষয়টির বিস্তারিত জানেন না। তার কাছে ফাইল এনে দেয়ার পর তিনি সাক্ষর করে পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে জানান। আমন্ত্রণের কাগজপত্র পর্যালোচনা করারও সুযোগ তার হয়নি বলে তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে নিশ্চিত করেছেন।

অস্ট্রেলিয়া সফরের বিষয়টির বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল রোববার শিল্প মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো: আলমগীর হোসেন দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজম্যান্ট (বিআইএম) এর মহাপরিচালক তার প্রতিষ্ঠানের ২৫ জন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে অস্ট্রেলিয়ায় প্রশিক্ষণে পাঠানোর অনুমতি প্রদানে যে আবেদন সচিব মহোদয় বরাবর করেছেন, সেটি পেন্ডিং আছে। আপাতত কোনো সিদ্ধান্ত হচ্ছে না। অনুমতি দিতে পারে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আপনি আমার কথায় বুঝে নেন।

এর আগে গত শনিবার বিকেলে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খানের একান্ত সচিব (উপসচিব) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিআইএম’র বিদেশ ভ্রমণের আবেদন স্থগিত করার নির্দেশ দেয়া হযেছে। সরকার এই মুহূর্তে বিশেষ প্রয়োজন না হলে বিদেশ ভ্রমণে আগ্রহী নয় বলেও মন্তব্য করেন।