হাইওয়ে পুলিশকে মানতে হবে ৬ দফা নির্দেশনা
মহাসড়কে চাদাঁবাজি আর কোনো অনিয়ম নয়। ইচ্ছেমতো আইনের বাইরে গিয়ে কিছুই করা যাবেনা। কার্যক্রমে গতিশীলতা ও অধিক স্বচ্ছতা আনতে মানতে হবে ৬ দফা নির্দেশনা। সাম্প্রতিক সময়ে হাইওয়ে পুলিশের চাদাঁবাজিসহ অনৈতিক কাজের খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে নেতিবাচক ভাবে আসার পর বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে পুলিশ সদর দফতর। এ অবস্থায় হাইওয়ে পুলিশকে দেয়া হয়েছে কঠোর নির্দেশনা। গত সপ্তাহের মাঝামাঝিতে এই নির্দেশনা দেয়া হয় হাইওয়ে পুলিশকে। পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট একাধিক সুত্রে এই নির্দেশনা প্রদানের খবর জানা গেছে।
জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অ্যাডিশনাল আইজিপি মো: দেলোয়ার হোসেন মিঞা গতকাল শনিবার দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, নির্দেশনা পাওয়া ছাড়াও তাঁরা সর্বদা তৎপর রয়েছেন হাইওয়েতে। নির্দেশনার বাইরেও তাদেরকে বেশি বেশি সতর্কতার সাথে কাজ করতে হচ্ছে। পর্যাপ্ত জনবল না থাকার পরও হাইওয়ে পুলিশকে বড় একটি এলাকার জন্য কাজ করতে হচ্ছে। তাঁর দৃষ্টিতে কোন ত্রুটি নেই বলে উল্লেখ করেন।
চাদাঁবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশ প্রধান দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমরা কাজ করছি। কোন সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে বা পাওয়া গেলে আমরা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিচ্ছি। চেষ্টা করছি কার্যক্রমে গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা আনতে। তিনি সাম্প্রতিক কিছু ব্যবস্থা নেয়ার পরিসংখ্যানও এ সময় উল্লেখ করেন।
জানা গেছে, দেশের ৮০৫৮ কিলোমিটার জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে সার্বক্ষণিক নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করতে কাজ করছে হাইওয়ে পুলিশ। হাইওয়ে পুলিশের কতিপয় সদস্যের চাঁদাবাজি ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এছাড়া হাইওয়ে পুলিশের কার্যক্রম আরও গতিশীল ও স্বচ্ছতা আনতেও উদ্যোগ নিয়েছে। এ ব্যাপারে গত সপ্তাহে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে হাইওয়ে পুলিশের প্রতি ৬ দফা লিখিত নির্দেশনা সংক্রান্ত একটি চিঠি জারি করা হয়েছে। দায়িত্ব পালনকালে হাইওয়ে পুলিশের সদস্যদের ওই নির্দেশনা মেনে চলতে বলা হয়েছে চিঠিতে। প্রায়শই হাইওয়ে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে চেকপোষ্ট বসিয়ে যানবাহন তল্লাশি এবং অননুমোদিত যানবাহন মহাসড়কে আটকানোর নামে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে হাইওয়ে পুলিশকে বিরত রাখতে চায় পুলিশ সদর দপ্তর।
পুলিশ সদর দপ্তরের চিঠিতে বলা হয়েছে, হাইওয়ে পুলিশ মহাসড়কে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তথাপি হাইওয়ে পুলিশের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন মিডিয়াতে নেতিবাচক খবর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নজরে এসেছে। হাইওয়ে পুলিশের কার্যক্রমে গতিশীলতা এবং অধিক স্বচ্ছতা আনতে ৬ দফা নির্দেশনা প্রতিপালন করতে বলা হয় চিঠিতে।
৬ ফা নির্দেশনায় হাইওয়ে পুলিশের কাছে বিদ্যমান বড়িওর্ন ক্যামেরা হাইওয়ে পুলিশ সদস্যদের ডিউটিকালীন সার্বক্ষণিক চালু রাখতে বলা হয়েছে। দিনের বেলা হাইওয়েতে অযথা কোনো চেকপোস্ট বসানো যাবে না। তবে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে চেকপোস্ট করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যকে ইউনিফর্মে রাস্তার পাশে নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে কাগজপত্র চেক করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই কাগজপত্র নিয়ে পুলিশ ভ্যান/পিকআপে বসে চেক করা যাবে না অথবা গাড়ির কাগজপত্র দূরে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, দিনে/রাতে চেকপোস্ট করার প্রয়োজন হলে যে সব হাইওয়েতে সিসি ক্যামেরা রয়েছে তার যথাসম্ভব নিকটবর্তী স্থানে চেকপোস্ট কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে; হাইওয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মনিটরিং বাড়াতে হবে, প্রয়োজনে মাঝে মাঝে সাদা পোশাকে বের হয়ে ডিউটি তদারকি করতে হবে; যানবাহনের মাত্রাতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে স্পিডগান ব্যবহারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোন অবস্থাতেই মহাসড়কের যানবাহন চলাচল অংশে অবস্থান করে স্পিডগান ব্যবহার করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় নিয়ে নিরাপ দূরত্বে অবস্থান করতে বলা হয়েছে সদর দপ্তরের চিঠিতে।
পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা প্রতিপালন করা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি (অপারেশনস্) মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ইতোমধ্যে আমরা পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা প্রতিপালন শুরু করেছি। সে অনুযায়ী হাইওয়ে পুলিশের সাড়ে ৪ শ বডি অর্ন ক্যামেরা ডিউটিকালে চালু রাখার কঠোর নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। যেসব পুলিশ সদস্য ডিউটিকালে ক্যামেরা চালু রাখবেন না তাদের অনুপস্থিত হিসেবে গন্য করা হবে। এছাড়া হাইওয়ে পুলিশের কোন সদস্য যদি অবৈধ আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়ান তাদের বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সাম্প্রতিক কর্মকান্ড : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানার ওসি মামুন রহমান ও সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) বিপ্লু বড়ুয়াসহ ছয়জনকে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার করা হয়েছে। গত ১৫ জুলাই সকালে তাঁদের থানা থেকে প্রত্যাহার করে হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা অঞ্চলের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ৩ জুলাই সিলেট থেকে ঢাকাগামী পণ্যবাহী একটি কাভার্ড ভ্যান আটক করেন মহাসড়কে কর্তব্যরত টহল পুলিশের সদস্যরা। পরে তাঁরা অবৈধ পণ্য পরিবহনের অভিযোগ তুলে ওই কাভার্ড ভ্যান থেকে ৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। এ নিয়ে বেসরকারি একটি টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার করা হয়। এরপর গতকাল ওই থানার ওসিসহ ছয়জনকে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার করা হয়। একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে অপরাধের মাত্রা অনুসারে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে গত ২১ এপ্রিল বগুড়া-নাটোর মহাসড়কে চলাচলকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ তুলে প্রতিকার চেয়ে বিক্ষোভ করেছেন চালকেরা। বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার কুন্দারহাট হাইওয়ে থানার সামনে বগুড়া-নাটোর মহাসড়কে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী এই অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন অটোরিকশাচালকেরা।
এর আগে গত ২০ মে চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে নাজিরহাট হাইওয়ে থানা পুলিশের চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বাস, ট্রাক, মাইক্রো, অটোরিকশা, নছিমন, করিমনসহ বিভিন্ন যানবাহনের চালকরা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ির কাগজপত্র দেখার নাম করে এসব চাঁদাবাজি করা হয় বলে অভিযোগ চালকদের। চালকদের অভিযোগ, হাইওয়ে সড়ক দিয়ে চলাচলকারী দূরপাল্লার পরিবহনের সঙ্গে হাইওয়ে পুলিশের বিশেষ চুক্তি রয়েছে। এ সড়কে চলাচলকারী একাধিক বাস চালক অভিযোগ করেন, চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি আঞ্চলিক মহাসড়কের পেলাগাজি দিঘী, চামার দিঘী, বাঘমারা পুকুর, ডলু নয়া বাজার, সরকারহাটসহ একাধিক স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে প্রতিনিয়ত গাড়ি থামিয়ে চাঁদা আদায় করে হাইওয়ে পুলিশ। যানজট নিরসন, মহাসড়কে ডাকাতি ও সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে হাইওয়ে পুলিশের নির্দিষ্ট দায়িত্ব থাকলেও দিনের অধিকাংশ সময় তারা ব্যস্ত থাকে চাঁদাবাজিতে।
এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারী শাহপুরী হাইওয়ে থানা পুলিশের বিরুদ্ধে কক্সবাজার -টেকনাফ সড়কে গাড়ি থামিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠে। রাতে ছাড়াও দিনে চেকপোস্ট বসিয়ে শাহপুরী থানা পুলিশের সামনে প্রতিটি গাড়ি থেকে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ করেন সড়কে চলাচলকারী চালকরা।