আবাসন খাত সংশ্লিষ্ট এক কোটি কর্মজীবীর মনে অনেক আশা আর স্বপ্ন জাগিয়ে প্রণয়ন করা হয়েছিল ঢাকা মহানগর এলাকার জন্য বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)। কিন্তু সে আশা আর স্বপ্নে গুড়েবালি পড়ে প্রণয়নকৃত ড্যাপ প্রকাশের পর। যাচাই বাছাই করে দেখা যায়, ড্যাপ ‘ত্রুটিপূর্ণ, বিতর্কিত ও বৈষম্যমূলক’। এ অবস্থায় অংশীজনদের পক্ষ থেকে সেটি সংশোধনের দাবি ওঠে। ২০২২ সালের আগস্ট থেকে সেই দাবি আজও চলমান। দাবির মুখে দফায় দফায় খসড়া হয়েছে, কাটছাঁট হয়েছে, কিন্তু নানা টানাপোড়নে চূড়ান্ত হয়নি ড্যাপ। ফলে থমকে গেছে ভবন নির্মান, ফ্ল্যাট বিক্রি নেমেছে অর্ধেকে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দুই লাখের অধিক ভূমি মালিক। সব মিলে আবাসন শিল্পে নেমেছে ধস, যেটি গামেন্টের পর অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে।

জানা গেছে, বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ২০২২ সালের ২৪ আগস্ট নতুন ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) কার্যকরের গেজেট প্রকাশ করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। কিছু জায়গায় ছাড় দিয়ে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ড্যাপ সংশোধন করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তাতে সরকারি-বেসরকারি আবাসন, অপরিকল্পিত এলাকা, ব্লক-ভিত্তিক আবাসন, একত্রীভূত প্লটে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) সুবিধা বাড়ানো হয়। পাশাপাশি ভবনের প্রশস্ততা ও উচ্চতা বাড়ানোরও সুযোগও বাড়ে। ভবন নির্মাণে সামনের সড়কের প্রশস্ততার ক্ষেত্রেও ছাড় দেওয়া হয়। এটাকে চরম বৈষম্যমূলক, ত্রুটিপূর্ণ ও বিতর্কিত বলে সে সময় থেকেই আপত্তি জানিয়ে সংশোধনের দাবী তোলেন অংশীজনরা। সম্প্রতি সেসব দাবীতে আবারও সোচ্চার তারা। তারা বলছেন, ঢাকাকে বাঁচাতে হলে ড্যাপ সংশোধনের বিকল্প নেই।

রাজধানী উন্নয়ন কতৃপক্ষ (রাজউক) সুত্র বলছে, সম্প্রতি কয়েক দফা বৈঠক করে অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে ড্যাপ এর একটি নতুন খসড়া প্রনয়ন করে গৃহায়ন ও গনপূর্ত মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রনালয় এখন পরবর্তী উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত করছে। আগামী বৈঠকেই খসড়া ড্যাপ নিয়ে আলোচনা হবে। তারপর চুড়ান্ত করা হবে ড্যাপ। সর্বশেষ উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত ২২ জুন।

দুই লাখের বেশি ভূমি মালিক ক্ষতির মুখে: জানা গেছে, ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপ ও বৈষম্যমূলক ফারের কারণে ঢাকা শহরের দুই লাখের বেশি ভূমি মালিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। একটু একটু করে জমানো সঞ্চয়, পেনশনের টাকা কিংবা ব্যাংক ঋণ করে স্বপ্নের এক টুকরো জমি কেনাই এখন ভূমি মালিকদের জন্য দায় হয়ে পড়ছে। কারণ তারা সেই জমিতে বাড়ি নির্মাণ করতে পারছে না। আবাসন উন্নয়ন প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে ভূমি মালিকদের কয়েক লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এছাড়া বৈষম্যমূলক ড্যাপের কারণে দ্রুত বাড়ছে ফ্ল্যাটের দাম এবং বাড়ি ভাড়া।

জানতে চাইলে ঢাকা সিটি ল্যান্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক প্রফেসর ড. দেওয়ান এম. এ. সাজ্জাদ বলেন, ড্যাপ ২০২২-২০৩৫ এ ঢাকা শহরের মাত্র ২০ শতাংশ পরিকল্পিত এরিয়ায় সু-উচ্চ ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা রেখে অবশিষ্ট ৮০ শতাংশ এরিয়াকে অপরিকল্পিত এরিয়ার ট্যাগ দিয়ে ভবনের উচ্চতা ও আয়তন হ্রাস কমিয়ে দেওয়া হয়। ফলে এই শহরের প্রকৃত ভূমি মালিকরা ভবন নির্মাণ করতে পারছেন না। নতুন করে কোনো ভবন নির্মাণ করতে গেলে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

জানা গেছে, ফার কমিয়ে দেওয়ার ফলে ভূমি মালিকগণ ভবন নির্মাণে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে পাড়া-মহল্লার রাস্তা-ঘাটগুলো অপ্রশস্তই থেকে যাচ্ছে এবং ফাঁকা জায়গাগুলো/সেমিপাকা জায়গাগুলো/পুরাতন জরাজীর্ণ ভবনগুলো অস্থাস্থ্যকরই থেকে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে, কারণ নির্মাণ কাজ কমে যাওয়ায় শ্রমিকরা কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন। ফ্ল্যাটের দাম এবং বাড়ি ভাড়া দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের জন্য আবাসনের সুযোগ আরও কঠিন করে তুলছে। জমির মালিকরা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ১৭১-এ নেমে এসেছে ঢাকা: গত রোববার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে স্থপতি ইন্সটিটিউট করে ড্যাপের ১২টি আইনগত ও তথ্যগত ত্রুটি তুলে ধরে। এ সময় ড্যাপ ‘বৈষম্যমূলক’ বর্ণনা করে এর সংশোধনের দাবি তুলে দেশে কর্মরত স্থপতিদের সংগঠনটি বলেছে, ঢাকা শহরকে বাঁচাতে হলে দ্রুত তথ্য হালনাগাদ করে নতুন ড্যাপ তৈরি করতে হবে। বিদ্যমান ড্যাপে নি¤œ শ্রেণির নাগরিকরা বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে এবং পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থে তড়িঘড়ি করে ড্যাপ রচনা করা হয়। পরবর্তী সময়ে গণশুনানি উপেক্ষা করে প্রহসনমূলক সংশোধন করা হয়। আইনি ব্যত্যয়, প্রকাশিত তথ্যের অপর্যাপ্ততা, প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, পরিবেশ বিপর্যয় (কৃষি জমি বিনষ্ট ও প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট), ভবন নির্মাণের অনুমোদন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি বৃদ্ধি, বৈষম্যমূলক নীতির প্রয়োগ, জনভোগান্তি বৃদ্ধিসহ অসংখ্য অসংগতি নির্ভর এই ড্যাপ বর্তমানে ভবন নির্মাণ শিল্পে স্থবিরতা সৃষ্টি করেছে। শহরের নাগরিক বাসযোগ্যতা এবং পরিবেশ আজ বিপন্ন করে তুলেছে। তার প্রমাণ ঢাকা শহর ড্যাপ প্রণয়নের পরে গত চার বছরে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ১৩৮ থেকে ১৭১-এ নেমে এসেছে।

গত এক বছরে ফ্ল্যাট বিক্রি অর্ধেকে নেমেছে: গত এক বছরের বেশি সময় ধরে আবাসন খাতের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি নেই। নতুন প্রকল্প ও প্রস্তুত (রেডি) ফ্ল্যাটের বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে। ড্যাপ সংশোধন না হওয়ায় নয়া প্রকল্পের সংখ্যাও কমেছে। একাধিক আবাসন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও পরবর্তী ঘটনার প্রভাবে আবাসন ব্যবসায় বড় ধাক্কা আসে। ফ্ল্যাটের বেচাবিক্রি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অর্ধেকের কম। ।

দেশের অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসের সংস্কৃতি গড়ে উঠতে শুরু করে নব্বইয়ের দশকে। ধীরে ধীরে আবাসন ব্যবসা জনপ্রিয় হতে শুরু করে। অন্যদিকে ঢাকার জমি উচ্চমূল্যের কারণে অনেক আগে থেকেই অ্যাপার্টমেন্টের দাম আকাশছোঁয়া। তাতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের নিচের মানুষের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট কেনাটা বেশ কঠিন। তারপরও এক হাজারের বেশি আবাসন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে দেশজুড়ে। তার বেশির ভাগই রাজধানী ঢাকায়। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে বছরে ৮ থেকে ১০ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট সরবরাহ করে থাকে।

নতুন ড্যাপ কার্যকর হওয়ার আগে মধ্য ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ভবনের যে আয়তন পাওয়া যেত, এখন ড্যাপের কারণে ৬০ শতাংশ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে জমির মালিকেরা আবাসন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রকল্প করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এতে আবাসন প্রকল্পের সংখ্যা কমেছে। যদিও ড্যাপ সংশোধনের দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছেন রিহ্যাব নেতারা।

থমকে আছে ভবন নির্মাণ : নির্মাণ খাতের প্রধান প্রধান উপকরণের দাম কমতির দিকে। কিছুদিন আগেও যেগুলো ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেন দাম কমেছে, জানতে চাইলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ খাতের কার্যক্রমে ধীরগতির কারণে রড-সিমেন্টসহ বিভিন্ন উপকরণের চাহিদা কমেছে। ফলে দেশের বাজারে এসব পণ্যের উৎপাদন ও দাম দুটিই কমেছে। তাদের মন্তব্য, সর্বশেষ প্রণীত ড্যাপ’র কারণে নতুন করে ভবন নির্মাণের কাজ থমকে গেছে। এ কারণে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য কমলেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই জমির মালিকদের।

রাজউক সূত্রে জানা যায়, ড্যাপে জনঘনত্ব ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে ভবনের উচ্চতা বেঁধে দেওয়া হয়। এজন্য বিভিন্ন মহল, বিশেষ করে স্থপতি ও আবাসন ব্যবসায়ীরা বেঁকে বসেন। শুরু হয় ড্যাপের নানা সংশোধন। আগে প্রশস্ত রাস্তা না থাকলেও আট থেকে ১০ তলা পর্যন্ত ভবন করা যেত। কিন্তু গেজেট আকারে ড্যাপ প্রকাশ হওয়ার পর সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অপ্রশস্ত রাস্তার ক্ষেত্রে চার থেকে পাঁচ তলা ভবন নির্মাণের বিধান রাখা হয়। ফলে জমির মালিক, হাউজিং প্রতিষ্ঠান, ডেভেলপারদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা বাণিজ্যিকভাবে বাড়ি ও ভবন নির্মাণ তুলনামূলক কমিয়ে দেন। বেড়ে যায় রাজধানীর ফ্ল্যাটগুলোর দাম। বাড়তে থাকে বাড়ি ভাড়াও। এ অবস্থায় আবাসন ব্যবসায়ী, জমির মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা বারবার ড্যাপ সংশোধন নিয়ে চাপ দিতে থাকেন। যে কারণে রাজউক বাধ্য হয়ে ড্যাপ সংশোধনী আনতে যাচ্ছে।

ড্যাপ নীতিমালার কারণে অন্য বছরগুলোর তুলনায় বিগত দুই বছরে রাজধানীতে নতুন করে ভবন নির্মাণের সংখ্যা কমার বিষয়টি স্বীকার করেছেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান। তিনি বলেন, ড্যাপ বাস্তবায়ন হওয়ার পর থেকে জমির মালিকেরা বিল্ডিং করার জন্য আবাসন কোম্পানিগুলোকে জমি দিতে চাচ্ছেন না। তারা নিজেরাও বাড়ি বা ভবন নির্মাণ করছেন না। কারণ, ফ্লোর এরিয়া রেশিওর জন্য অনুমোদনের সময় ভবনের উচ্চতা কম দেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে নানা শর্ত। যে কারণে আগে যেখানে ১০ তলা বিল্ডিং করা যেত সেখানে এখন পাওয়া যাচ্ছে পাঁচ তলার অনুমোদন। এসব কারণে ড্যাপ পাস হওয়ার পর থেকে রাজধানীতে ভবন নির্মাণের সংখ্যা কমে গেছে। নতুন করে ড্যাপ সংশোধন হলে ফের ভবন নির্মাণ শুরু হবে, এমন আশা প্রকাশ করেন ওয়াহিদুজ্জামান।