গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা দুঃসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে অনেক আগেই। কোথাও যাওয়ার জন্য নাগরিকদের রাস্তায় নেমেই এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। গন্তব্যে যাওয়ার জন্য তাড়া আছে, যানবাহনের তীব্র সংকট। অফিসে যাওয়া, বাচ্চার স্কুল, বিয়ে-দাওয়াত, পার্টিতে যাওয়া, এমনকি রোগী নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া প্রয়োজনীয় কোনো গন্তব্যেই যে সময়মতো পৌঁছানো যাবে, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। বাসে উঠতে গেলে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ট্যাক্সিক্যাব অপ্রতুল, ভাড়াও অতিরিক্ত।
জানা গেছে, যানজটের ফলে নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা, বাড়ছে রোগব্যাধি। শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণে নানা সংক্রামক ব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছে রাজধানীর বিপুলসংখ্যক মানুষ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, যানজটের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সব রুটে যাত্রীদের চলাচলে কমপক্ষে তিন কর্মঘণ্টা সময় অপচয় হয় প্রতিদিন যানজটের কারণে বিপুল পরিমাণ জ্বালানিরও অপচয় হয়। কিন্তু এ থেকে পরিত্রাণের যেন কোনো উপায় নেই। বিভিন্ন সময়ে নানামুখি কর্মসূচি-পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হলেও বাস্তবায়িত হয়েছে খুবই কম। ফলে সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সেখানেই রয়ে গেছে। অথচ দুর্বিষহ যানজটের জন্য পরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতার অভাবকেই দায়ী করা হয়।
সূত্র জানায়, রাজধানীতে রাস্তার তুলনায় প্রায় ৩ লাখ যানবাহন বেশি চলছে। এছাড়া প্রতিদিন গড়ে ২৩০টি নতুন গাড়ি রাস্তায় নামছে। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী যে কোনো শহরে মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ যান চলাচলের জন্য রাস্তা থাকা আবশ্যক। ঢাকা শহরের মোট আয়তন ৮১৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার। এ হিসাবে ২০৪ কিলোমিটার রাস্তার প্রয়োজন হলেও ঢাকা শহরে প্রধান রাস্তার পরিমাণ মাত্র ৮৮ কিলোমিটার। এই পরিমাণ রাস্তায় ৫ লাখ যানবাহন চলাচল করছে। অথচ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এই পরিমাণ রাস্তায় ২ লাখ ১৬ হাজার যানবাহন চলাচল করার কথা।
্এদিকে ২০ বছরের বেশি পুরোনো বাস ও মিনিবাস চলাচল পারবে না। অন্যদিকে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান প্রভৃতি মালবাহী মোটরযানের আয়ুষ্কাল হবে ২৫ বছর। সম্প্রতি যানবাহনের ইকোনমিক লাইফ (অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল) নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ এর ধারা ৩৬-এ দেওয়া ক্ষমতাবলে সরকার বাস ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে ২০ বছর এবং ট্রাক, কাভার্ডভ্যান প্রভৃতি মালবাহী মোটরযানের ক্ষেত্রে ২৫ বছর ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ করলো। এ আদেশ আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে বলেও প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা, সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পরিবেশ দূষণ কমানো এবং সড়কে শৃঙ্খলা আনতে যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী মোটরযানের আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে ২০২৩ সালের ১৭ মে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তখনো বাস ও মিনিবাসের ২০ বছর এবং ট্রাকের আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করা হয় ২৫ বছর। কিন্তু পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আপত্তির মুখে ওই বছরের ৩ আগস্ট আয়ুষ্কাল নির্ধারণের প্রজ্ঞাপনটি স্থগিত করা হয়।
এবিষয়ে তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডের মালিক তাজুল ইসলাম বলেন, ঢাকা সড়ক মালিক সমিতি, বাংলাদেশ পরিবহন ফেডারেশন ও শ্রমিক ফেডারেশনের সঙ্গে বৈঠকে বসে আরও কিছু সময় চাইব।
ঢাকা সড়ক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, আমাদের জানামতে ১ জুলাই থেকে যদি বিশ বছরের বেশি পুরনো বাস মিনিবাস সত্যিই না চলতে দেওয়া হয়- তাহলে খুব একটা বেশি প্রভাব পড়বে না। কারণ বাস মিনিবাস এত পুরনো খুব একটা নেই। দুএকটা থাকলেও সেগুলো হয়তো রাতে লুকিয়ে চলাচল করতে পারে। কিন্তু ট্রাকের বেলায় একটা সমস্যা হতে পারে। যেমন এখনো পঁচিশ বছরেরর অধিক পুরনো ট্রাক দেশে রয়ে গেছে। রাজধানীতেও সেগুলো চলাচল করে। এখন ১ জুলাই থেকে যদি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে ্একটা সংকট হতে পারে। সেজন্য আমাদের প্রস্তাব ছিল, এসব মালিকদের স্বল্প সুদে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজে তাদেরকে নতুন ট্রাক কেনার সুযোগ দেওয়া হলে সবার জন্যই সুবিধা হবে। নইলে একটা ভোগান্তি সবাইকে পেয়ে বসবে।
ট্রাক মালিক ইউসুফ বলেন, রাজধানীসহ দেশব্যাপী ২০ বছরের পুরনো বাস মিনিবাস ও ২৫ বছরের অধিক পুরনো ট্রাক রয়েছে লাখ লাখ। এসব গাড়ির রিপ্লেস না করে , মালিকদের সঙ্গে সমঝোতা বা বিকল্প কিছু একটা না করে ১ জুলাই থেকে কীভাবে নিষিদ্ধ করা হবে। এগুলো কোথায় যাবে? দেশে তো এত গাড়ি ডাম্পিংয়েরও উপযুক্ত জায়গা নেই। সেজন্যই আমরা আরও সময় চাইছি।
এদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সড়কপথে চলাচলকারী সব ধরনের যানবাহনের ভাড়া বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে সমিতির মহাসচিব মো. সাইফুল আলমের স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে এই আবেদন করা হয়। চিঠিতে বলা হয়, বাস, মিনিবাস, ট্রাক, পিকআপ, মিনি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান এবং প্রাইমমুভারসহ (পণ্যবাহী পরিবহন) সব ধরনের যানবাহনের ভাড়া পুনঃনির্ধারণের জন্য আবেদন করা হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০২২ সালের ৬ আগস্ট ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৮০ থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। সে সময় শুধু ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ভিত্তিতে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার বাস এবং মিনিবাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ২.২০ টাকা এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাস ও মিনিবাসের ভাড়া যথাক্রমে ২.৪০ টাকা ও ২.৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে, ওই সময় গাড়ির টায়ার-টিউব, লুব্রিকেন্ট, ব্রেকসু এবং অন্যান্য খুচরা যন্ত্রাংশের মূল্যবৃদ্ধি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া, ট্রাক, পিকআপ, মিনি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও প্রাইমমুভারের (পণ্যবাহী পরিবহন) ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা না থাকায় এসব যানবাহনের ভাড়া সমন্বয় বা বৃদ্ধি করা হয়নি।
সমিতির দাবি, ডলারের দাম এক বছরের ব্যবধানে ৮৪ থেকে ১২১ টাকায় উন্নীত হওয়ায় পরিবহন খাতে ব্যবহৃত আমদানি করা যন্ত্রাংশের দাম প্রায় দেড় গুণ বেড়েছে। এর মধ্যে টায়ার-টিউব, লুব্রিকেন্ট, ইঞ্জিনের যন্ত্রপাতি, ব্রেকসুসহ বিভিন্ন উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য। ফলে পরিবহন মালিকরা ব্যবসা পরিচালনায় ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপের মুখে পড়ছেন।
জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব মহানগরী ও দূরপাল্লায় চলাচলকারী বাসের ভাড়া বাড়াতে চাচ্ছেন মালিকরা। এক্ষেত্রে মহানগরীতে চলাচলকারী বাসের ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩ টাকা ৬০ পয়সা করার প্রস্তাব জানানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রস্তাবে বাসের ভাড়া ৪৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। মহানগরের পাশাপাশি দূরপাল্লার গন্তব্যেও বাস ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা ৪৫ পয়সার ভাড়া বাড়িয়ে ৩ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ দূরপাল্লার বাসে ভাড়া ২২ দশমিক ৪৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাসভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ঢাকার সড়কে চলাচলকারী বেশিরভাগ বাসের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এসব লক্কড়ঝক্কড় বাসে যাত্রীরা দীর্ঘদিন ধরে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তিনি মনে করেন, এ ধরনের বাস অপসারণ না করে ভাড়া বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। দূরপাল্লার কিছু বাসের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি প্রস্তাব দেন, নতুন ও মানসম্পন্ন বাস নামানো হলে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।