তোফাজ্জল হোসাইন কামাল : ঢাকাবাসীর রাগ নিবারণ করার জন্য ‘গোসসা পার্ক’! শুরুতেই এমন উদ্যোগের বিষয়টি নিয়ে চিত্তাকর্ষক আলোচনায় অম্লমধুর দিকগুলো উঠে আসলেও একটা পর্যায়ে ঢাকাবাসীর মনে ঠাইঁ পায় সেটি। অতঃপর অপেক্ষার পালা শুরু, কিন্তু কাক্সিক্ষত সেই পার্কের দেখা নেই। ১০ মাসে যে পার্কটির একটি অবয়ব ফুটে উঠার দাফতরিক কথা, সেটি এখন নানা টানাপোড়নের পর সবার জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে সাত বছর পর। বিনোদনের জন্য নির্মিত এই পার্কটির দুয়ার খুলে দেয়া হচ্ছে মে মাসের শুরুতেই। এজন্য শেষ মুহূর্তে চলছে গোছানোর কাজও। ব্যতিক্রমী নানা সৃষ্টিশীলতা নিয়ে গড়ে তোলা এই পার্কে ঢুকলেই ভালো হয়ে যাবে মন, মুছে যাবে নাগরিক জীবনের সব মন খারাপ করা ঘটনা; কেটে যাবে সব ‘গোসসা’। সব কিছু মিলে এক ভালো লাগা- ভালোবাসায় ভরে উঠবে মন।

সাত বছর আগে রাজধানীর ব্যস্ত এলাকা একপাশে গুলিস্তান ঘেঁষে, আরেক পাশে প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ের প্রধান ফটক, অন্য পাশে দেশের ব্যতিক্রমী স্থাপনা ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনের প্রধান ফটকের সামনের অংশে অবস্থিত ঐতিহাসিক ওসমানী উদ্যানের ভেতরেই গোসসা পার্কের অবয়ব সৃষ্টির কাজ শুরু হয়। একটি ব্যতিক্রমী ইচ্ছা থেকে যে ওসমানী উদ্যান‘র কামানসহ অন্যান্য স্থাপনা ঠিক রেখেই গোসসা নিবারণী পার্ক গোছানোর কাজ শুরু হয়েছিল, তার এখন শেষ পর্যায়ে।

২০১৮ সালের শুরুতে এর নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করে ঢাকা দক্ষিণের সে সময়ের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছিলেন, কর্মস্থলে ও পরিবারে প্রতিনিয়ত মানুষ গোসসা করে, রাগ হয়। এই পার্কটি এমনভাবে তৈরি করা হবে যাতে এখানে কেউ মন খারাপ নিয়ে এলে পরিবেশের সান্নিধ্যে তার মন ভালো হয়ে যাবে, উৎফুল্ল মনে নতুন উদ্যমে সে আবার কাজে ফিরে যেতে পারবে। পার্কে আসা মানুষের মন ভালো করতে, উৎফুল্ল রাখতে পানির আধার, চা, কফি ও স্যান্ডউইচ খাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। খেলা দেখার জন্য পার্কের ভেতরে থাকবে বড় কয়েকটি টিভি স্ক্রিন। ভেতরে ঢুকতেই পার্কটির জলাধারের পাশ থেকে পুরোনো দিনের গান ভেসে আসবে। শোনা যাবে নতুন দিনের নানা সংগীতও, যা মনকে সতেজ করবে। পার্কটিতে ঢুকলে মানুষের গোস্সা বা রাগ ভালো হয়ে যাবে, মন হবে উৎফুল্ল, এসব শুনিয়েছিলেন তিনি। এরপর ওই বছরের শেষে নতুন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, ‘খুবই ধীর গতিতে’ চলা পার্কের কাজে গতি আনতে তিনি নিজে দুবার পরিদর্শন করেছেন।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সাত বছরে সেই কাজের শতকরা ৯৩ ভাগ শেষ হয়েছে, বাকি কাজ শেষ করে আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পার্কটি নাগরিকদের জন্য খুলে দেওয়া হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ পার্কে থাকবে স্বাধীনতা চত্বর, বসার জোন, জিম, শিশু কর্নার, এলইডি টিভি, ওয়াইফাই জোন, স্ট্রিট লাইট ও ওয়াকওয়ে। এছাড়া টেবিল টেনিস, বিলিয়ার্ড বোর্ড, ক্রিকেট নেট প্র্যাকটিস সুবিধা পাবেন খেলাধুলায় আগ্রহীরা। পার্কে ফুড কর্নার, নগর জাদুঘর, পাঠাগার, কার পার্কিং, এটিএম বুথ, ওষুধের দোকানও থাকবে। আর পুরো পার্ক থাকবে সিসি ক্যামেরার নজরদারিতে।

সরজমিনে দেখা গেছে, চারদিকে লোহার গ্রিল ও কিছু অংশ টিন দিয়ে ঘিরে রাখায় সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারছে না পার্কে। ভেতরে রাজমিস্ত্রিরা শেষ সময়ের কাজ করছেন। উন্নয়ন কাজ প্রায় শেষ, ওয়াকওয়ের স্ল্যাবের মাঝখানে সিমেন্ট দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে। পার্কে থাকছে নগর জাদুঘর, একটি পাঠাগার, নির্দিষ্ট জায়গায় একাধিক খাবারের দোকান, গাড়ি রাখার স্থান, ব্যায়ামাগার, শিশুদের খেলার জায়গা, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, টেবিল টেনিস ও বিলিয়ার্ড খেলার ব্যবস্থাও শেষ করা হয়েছে। লেকের পাড় উন্নয়ন, ঘাট তৈরি, মাঠ উন্নয়নের কাজও শেষ। বিদ্যুতের উপকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে।

পুরান ঢাকার হোসাইনি দালান রোডের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল বলেন, আমি বহু বছর ধরেই সকালে এই উদ্যানে হাঁটাহাঁটি করতাম। সাত-আট বছর ধরে বন্ধ থাকায় আমাকে যেতে হয় রমনা পার্কে। আগে এটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। এখানে বিকেলে বাচ্চারা খেলাধুলা ও দৌড়াদৌড়ি করত। আমি ব্যক্তিগতভাবে কয়েকবার পার্কটি দ্রুত খুলে দেওয়ার জন্য বলেছি। তারা বারবার বলছে, উদ্যানটির উন্নয়নকাজ চলছে। কাজ শেষ হলেই খুলে দেওয়া হবে। কয়দিন আগে শুনলাম খুলে দিবে। তখন আবার এখানে সকাল-বিকাল আসতে পারব আশা করছি।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক খায়রুল বাকের দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, মেয়র পরিবর্তন, ঠিকাদার পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে পার্কটির উন্নয়ন কাজ শেষ করতে দীর্ঘ সময় লেগে গেছে। এখন কাজ প্রায় শেষ, আমরা আশা করছি আগামী দেড়-দুই মাসের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে। আশা করছি মে মাসের প্রথম সপ্তাহের আগেই কাজ শেষ হবে এবং মে মাসের শুরুতেই সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।

২৯ একর জায়গাজুড়ে এ উদ্যানটির সংস্কারে প্রথমে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৫৮ কোটি টাকা। পরে দ্বিতীয় দফায় প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ৯০ কোটি টাকা করা হয়। পরে আরেক দফা প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ১০৮ কোটি টাকা উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়।