ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস মানে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণার দিন। এই দিনে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পঠিত হয়। শোনা যায় মেজর জিয়াউর রহমানের সাহসী কণ্ঠ। সেই ঘোণার সাথে আমরাও সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। গর্জে উঠেছিলাম বৈষম্যবিরোধী চেতনায়। ঘোষণা করেছিলাম স্বাধীনতার লড়াই। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম। মুক্তির চেতনায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ।

মুলত আমরা, স্বাধীনভাবে চলতে চাই। মনের কথা বলতে চাই। ইচ্ছে মতো উড়তে চাই। নিরাপদে ঘুরতে চাই। কর্ম করে খেতে চাই। ন্যায্য পাওনা পেতে চাই। আসলে বাধা লড়তে পারি। লড়াই করে মরতে পারি। এর নামই তো স্বাধীনতা আন্দোলন। মুক্তির সংগ্রাম। এভাবেই এসেছিলো আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতায় ঘুন ধরিয়েছিলেন আমাদের কিছু রাজনীতিবিদ। ফ্যাসিবাদী আচরণে তারা পাকিস্তানী শাসকদেরকেও হার মানায়। নির্যাতনের চরমমাত্রায় জনগণকে অতিষ্ট করে তোলে। কথায় কথায় গুম-খুন আর আয়নাঘরের বাসিন্দা বানিয়ে ফেলে। সেজন্য আবারও নতুন করে সংগ্রাম তৈরি হয়। চব্বিশের লাল জুলাইয়ে আবারো ফ্যাসিবাদমুক্ত নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়।

মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা মানুষের ফিতরাত। জন্মগত চেতনা। যখনই অধিকারে বাধা আসে তখনই বিগড়ে যায়। স্বাধীনতার জন্য চেষ্টা করে। অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করে। হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। লড়াই করে। প্রতিরোধ গড়ে। বড়োদের মতো শিশুরাও লড়াই করে। কান্না করে হলেও নিজের পক্ষে রায় টেনে নেয়।

বাংলায় প্রথম স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন বখতিয়ার। পুরো নাম ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি। এই তুর্কী বীর বাংলার মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করেছিলেন। নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত ও অসহায় মানুষেরা তার পক্ষ নিয়েছিলো। তিনি বিজয়ী হয়েছেন লক্ষ্মন সেনকে পরাজিত করে। সময়টি ছিলো বারো শত চার সাল।

সেই থেকে এগিয়ে গেছে আমাদের স্বাধীনতার চর্চা। স্বাধীনভাবে পথ চলতে আমরা প্রথম বড় ধরনের ধাক্কা খাই ১৭৫৭ সালে। পলাশীর প্রান্তরে আসে সেই ধাক্কা। ইংরেজদের হাতে। বিশ^াসঘাতকতার জন্য আমরা স্বাধীনতা হারাই। নির্মমভাবে শহীদ হন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদদৌলা। তাঁর পূর্ণ নাম নবাব মনসুর উল মুলক সিরাজ উদদৌলা শাহ কুলী খান মির্জা মুহম্মদ হয়বত জঙ্গ বাহাদুর। সেই থেকে ইংরেজদের কাছে স্বাধীনতা হারালাম। আমাদের গোলাম বানিয়ে শাসন করলো বৃটিশরা। সেই গোলামী থেকে মুক্ত করতে লড়াই করেছেন মীর নিসার আলী তিতুমীর। তিনি বাঁশের কেল্লা গড়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। অবশেষে তিনি শহীদ হয়েছেন। অমর হয়ে আছেন আমাদের সিপাহসালার।

হাজি শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজী থেকে শুরু করে নবাব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী, হাজী মুহম্মদ মহসীন, মন্নুজান প্রমুখের হাত ধরে আমরা আবার নতুন করে জেগে উঠি। লেখাপড়ার সুযোগ পাই। স্বাধীনতার পথে হাঁটতে শিখি। ১৯০৫ সালে বাংলাবিভক্তির পরে স্বাধীনতার নতুন সূর্য উদয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়। নবাব স্যার সলিমুল্লাহর মতো মানুষেরা এ পথে আরো খানিকটা এগিয়ে নেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো রাজনীতিবিদগণ আমাদের স্বাধীনতার পথকে আলোকিত করেছেন।

স্বাধীনতার সূর্য উঠলো ১৯৪৭ সালে। আমরা আনন্দিত হলাম। ভাবলাম, আর পরাধীন থাকতে হবে না। বঞ্চিত হবো না। অধিকারের সব কিছু হাতের কাছেই পাবো। কিন্তু না। আবারো বৈষম্য। ভাষার জন্য লড়তে হলো। জীবন দিতে হলো। রক্ত দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা আদায় করলাম। শহীদ হলেন আবুল বারাকাত, রফিকউদ্দিন আহমদ, শফিউর রহমান, আবদুস সালাম, আবদুল জব্বার প্রমুখ।

অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই সংগ্রাম চলছেই। চলছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বৈষম্যহীন করার আন্দোলন। এই আন্দোলনের পথে কেটে গেলো পচিশটি বছর। অবশেষে ১৯৬৯ সালে শুরু হলো গণআন্দোলন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমরা পাকিস্তানকে হারিয়ে দিলাম। তবুও অধিকার ফিরে পেলাম না। স্বাধীনতা আদায়ের ডাক আসে ৭ মার্চে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে পরিচিত রেসকোর্স ময়দান থেকে।

পাকিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার জন্য তখনও প্রচেষ্টা অব্যাহত। বাংলাদেশের মানুষ এগিয়ে গেছেন স্বাধীনতার পথে। লড়াই করার জন্য প্রস্তুত। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর দমননীতির কারণে ফুঁসে ওঠে বাংলাদেশের মানুষ। ২৬ মার্চ কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারিত হয়। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ছিলেন এম এ জি ওসমানী। পুরো নাম জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। তিনি মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি এবং সর্বাধিনায়ক। তাঁর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। মুক্তিবাহিনীর মরণপণ লড়াই এবং গণমানুষের আন্তরিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। অবশেষে বিজয় আসে ১৬ ডিসেম্বরে। উল্লাসে মেতে ওঠে সমগ্র বাংলাদেশ।

বিজয়ের এই উল্লাস খুব বেশি দিন থাকেনি। মুখের হাসি, হৃদয়ের উচ্ছ্বাস অচিরেই মিশে যায় হাওয়ায় হাওয়ায়। স্বাধীনতা পরবর্তী শেখ মুজিবের প্রশাসন আবার পাকিস্তানী বাহিনীর চেহারায় ফিরে যায়। নামি বেনামি বিভিন্ন বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। রক্ষীবাহিনীর নির্মম অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য অসংখ্য মানুষ বাড়ি ছাড়া হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী মেজর আবদুল জলিলের মতো সেক্টর কমান্ডারও রেহাই পায়নি শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন থেকে। আলিম-উলামাসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাদের হাতে।

পঁচাত্তরের আগস্ট পরবর্তী নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়। ডামাডোল শুরু হয় বাংলাদেশে। আবার স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার আন্দোলন। সামরিক ও বেসামরিক নাটকীয়তায় অবশেষে পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরে অর্জিত হয় নতুন বিপ্লব। স্বাধীনতা সুরক্ষার মহানায়ক হিসেবে আবির্ভুত হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। দিনটি ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে স্থান করে নেয়।

স্বাধীনতার পথ মসৃণ থাকেনি কখনো। নানা চরাই উৎড়াইয়ের দোলাচালে এগিয়ে চলে বাংলাদেশ। ক্রমশ স্বৈরাচার হয়ে ওঠেন শাসকগোষ্ঠী। স্বৈরাচারের ঐরাবতে চড়ে বাংলাদেশ শাসন করেন হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদ। গণমানুষের মনে আবারো ক্ষোভ জন্মে। শুরু হয় গণআন্দোলন। নব্বইয়ের ছাত্র-গণআন্দোলনে স্বৈরাচারের পতন ঘটে। স্বাধীনতার কোমল আলো হেঁসে ওঠে বাংলদেশের সবুজ জমিনে।

পথের বাঁকে নতুন পথের মিলন ঘটে। অনেকেই সঠিক পথ চিনতে বিভ্রান্ত হন। তবুও পথের বাঁক-মোহনা পছন্দের স্থান। আড্ডা জমে। বাজার বসে। হৈচৈ হয়। নানা অস্থিরতায় এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্যটা আকাশে জ¦লজ¦ল করছিলো। কিন্তু ক্রমশ কালো মেঘ জমে বাংলাদেশের আকাশে। ঢেকে নেয় স্বাধীনতার সূর্য। কথা বলার অধিকার নেই। অধিকার নেই নিজের মতো করে জীবন পরিচালনার। শাসকগোষ্ঠীই হয়ে ওঠেন সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। সরকারি বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের স্বকীয়তা কেড়ে নেয়া হয়। দুর্বিত্তায়নের কালো থাবা বিস্তৃত হয় সকলখানে। জীবন-জীবিকার চাবিকাঠি তারা নিজ হাতে তুলে নেয়। দেশের সাধারণ মানুষ হয়ে পড়ে জিম্মি। প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে নেয়া হয়। গুম, খুন, হত্যা, গ্রেফতার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে পুরো জাতি। পিতার আদলে শেখ হাসিনাও স্বৈরাচারের আসন পেরিয়ে ফ্যাসিবাদের নেত্রী হয়ে ওঠেন।

দেড় দশকের এই কালো অধ্যায়ে মানুষ বঞ্চিত হয় ভোট এবং ভাতের অধিকার থেকে। বঞ্ছনার চূড়ান্ত পর্বে অধিকারের কথা উচ্চারণ করে শিক্ষার্থীসমাজ। অধিকারের সাহসী উচ্চারণে বেপরোয়া হয়ে ওঠে শেখ হাসিনার প্রশাসন ও তার শাসকশ্রেণি। শুরু হয় জুলুম নির্যাতনের নতুন স্টাইল। চেতনার বুকে বুলেটবিদ্ধ করে তারা। শহীদ আবু সাঈদের স্বাধীনচেতা বুকের রক্ত ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলাদেশে। জন্ম নেয় হাজারো আবু সাঈদ। বৈষম্য নিরসনে এক আওয়াজে মিলিত হয় সারাদেশের শিক্ষার্থীরা। বুলেটের সামনে সাহসী বীরের বেশে এগিয়ে আসে মুগ্ধ-রায়হানরা। পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের পাশাপাশি এগিয়ে আসে প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্কুল, কলেজ মাদরাসাসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন পরিণত হয় জন¯্রােতে। রক্তের ¯্রােত আরো বেশি তীব্রতর হয়ে ওঠে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে তাদের পাশে ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় কৃষক, শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, দোকানদার থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, পেশাজীবীসহ সকল শ্রেণিপেশার মানুষ।

বাংলাদেশের সকল মুক্তিকামী মানুষ একদিকে। আরেক দিকে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার এবং তার আজ্ঞাবহ পেটুয়া বাহিনী। মুখোমুখি অবস্থানের শেষপর্বে শিক্ষার্থী-জনতার ঐতিহাসিক ঢলে ভেসে যায় ফ্যাসিবাদ। উপায়ন্তর না দেখে পার্শ^বর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নেন ফ্যাসিবাদের জননী শেখ হাসিনা। সৃষ্টি হয় নতুন স্বাধীনতার আরেক ইতিহাস। এই ইতিহাস নতুন করে উনিশশো একাত্তরের উত্তাল দিনের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। স্মরণ করিয়ে দেয় নতুন বাংলাদেশ গড়ার শাশ^ত অঙ্গীকারের কথা। নতুন করে আবারো ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি শোনা গেলে দেশের মানুষ আবারো চব্বিশের জুলাইয়ের মতো জেগে উঠবে স্বাধীনতা রক্ষায়।

লেখক: কবি, গবেষক, প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়।