খাদ্য উৎপাদন নয়, নৈতিকতার অভাবে বিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষ চলছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ২০২৪ ইং সালে ৬৭৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত। এটা উৎপাদনের ব্যর্থতার জন্য না। অর্থনীতির সিস্টেমের ব্যর্থতার জন্যই এই সমস্যা। নৈতিকতার অভাবে এই সমস্যার সৃষ্ট হয়েছে। এ সমস্যা উত্তরণে আমাদের নৈতিকতা, মানুষের মধ্যে চেক এন্ড ব্যালেন্স এবং আমাদের অবশ্যই সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়তে তিনি কয়েকটি সুপারিশ উপস্থাপন করেন।
গতকাল সোমবার ইতালির রোমে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টায় বিশ্ব খাদ্য ফোরামের সমাবেশে প্রধান বক্তার বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। প্রফেসর ইউনূস বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে খাদ্য কেবল ক্যালরি নয়, এটি একটি মর্যাদা। এটি এহলো ন্যায় বিচারের অংশ। এসময় তিনি ২০২৪ ইং সালের বাংলাদেশে হয়ে যাওয়া বিপ্লবের কথা স্মরণ করেন। তিনি বিপ্লবে যুবকদের ভূমিকার প্রসংশা করেন।
তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৪ইং সালে ৬৭৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত। এটা উৎপাদনের ব্যর্থতার জন্য না। অর্থনীতির সিস্টেমের ব্যর্থতার জন্যই এই সমস্যা। নৈতিকতার অভাবে এই সমস্যার সৃষ্ট হয়েছে। এ সমস্যা উত্তরণে আমাদের নৈতিকতা, মানুষের মধ্যে চেক এন্ড ব্যালেন্স এবং আমাদের অবশ্যই সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে।
তিনি প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ক্ষুধা থামানো খুব সাধারণ ব্যাপার। যুদ্ধ বন্ধ করো, ডায়ালগ শুরু করো, খাবারের অধিকার নিশ্চিত করো যেখানে প্রয়োজন, প্রতিশ্রুতি রক্ষা করো, জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করো, এসময় তিনি আঞ্চলিক ফুডব্যাংক স্থাপন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, সাপ্লাই চেইনের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। সেইসাথে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সহায়তার পাশাপাশি বিশেষ করে যুবকদের এর সাথে সম্পৃক্ত করার প্রতি জোর দেন প্রফেসর ইউনূস। তাদের আর্থিক সহায়তার সাথে সাথে অবকাঠামো নির্মাণে সহযোগিতা করার কথা বলেন তিনি। রফতানিতে ভারসাম্যতা আনার কথা বলেন শান্তিতে নোবেল জয়ী প্রধান উপদেষ্টা। প্রযুক্তগত উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেন প্রফেসর ইউনূস।
প্রফেসর ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ ছোট ভূমির দেশ। আয়তনে ইতালির অর্ধেক। কিন্তু আমরা ১৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষকে খাওয়াই, পাশাপাশি আশ্রয় দিচ্ছি ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে, যারা মিয়ানমারে সহিংসতার মুখে পালিয়ে এসেছে। আমরা ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি, যা আমাদের প্রধান খাদ্যশস্যে। আমরা বিশ্বের শীর্ষ ধান, শাকসবজি ও মিঠাপানির মাছ উৎপাদনকারী দেশগুলোর একটি। আমাদের কৃষকেরা ফসল চাষের ঘনত্ব ২১৪ শতাংশে উন্নীত করেছেন। আমরা ১৩৩টি জলবায়ু-সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছি। ক্ষুধা দূর করার জন্য আমরা কয়েক বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে পারিনি, বিশ্ব অস্ত্রের জন্য ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এভাবেই কি আমরা অগ্রগতির সংজ্ঞা দিচ্ছি’- বলে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা কৃষক মেকানাইজেশনে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দিয়েছি। শক্তিশালী খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থাগড়ে তুলেছি। শিশুদের খর্বতা কমেছে, খাদ্যতালিকা বৈচিত্র্যময় হয়েছে মাটি, পানি ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার মাধ্যমে। কৃষি আরও সবুজ হয়েছে। তিনি বলেন, আমি আনন্দিত যে ‘ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালাচারাল অরগানাইজেশন (এফএও)’ কর্তৃক ২০১৬ সালে গঠিত ‘নোবেল পিস লরিয়েটস অ্যালায়েন্স ফর ফুড সিকিউরিরটি অ্যান্ড পিস’, যার একজন সদস্য আমি; সেটি এখন এফএও’র একটি মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমি আশা করি এটি আরও নতুন মাইলফলক সৃষ্টি করবে। তিনি যুবকদের বলেন, তোমরা চাকুরী প্রত্যাশী হয়ো না চাকুরী দাতা হও। এসময় তিনি সবইকে সামাজিক ব্যবসা করার আহ্বান জানিয়ে তার থ্রি জিরো তত্ত্ব বাস্তবায়নের কথা বলেন।
ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘আজকের তরুণরা আগের মতো নেই। তারা সংঘবদ্ধ। তারা সৃজনশীল। তাদের হাতে এমন প্রযুক্তি রয়েছে, যা মাত্র ২০ বছর আগে অকল্পনীয় ছিল। আসুন, আমরা তাদের চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে না বলি। আসুন, আমরা তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষমতায়ন করি। আসুন, আমরা তাদের বলি- আপনি চাকরিপ্রার্থী নন, আপনি চাকরি সৃষ্টিকারী। আসুন, আমরা বিনিয়োগ তহবিল এবং সামাজিক ব্যবসা তহবিল তৈরি করে তাদের মূলধনের সুযোগ দিই। আসুন, আমরা কৃষি-উদ্ভাবন হাব গড়ে তুলতে সাহায্য করি। আসুন, আমরা কৃষি-প্রযুক্তি, বৃত্তাকার খাদ্য ব্যবস্থা, জলবায়ু-স্মার্ট উদ্যোগকে সমর্থন করি- সব কিছুই যুব সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিতে পারে। আমরা যদি তরুণদের জন্য বিনিয়োগ করি, তাহলে আমরা শুধু বিশ্বকে দেবো না, আমরা বিশ্বকেও বদলে দেবো।’
এর আগে ইতালির রাজধানী রোমে খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদর দপ্তরে পৌঁছালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। সোমবার স্থানীয় সময় বিকেলে ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরাম (ডব্লিউএফএফ)-এর ফ্ল্যাগশিপ আয়োজনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করবেন ড. ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, এফএও সদর দপ্তরে পৌঁছালে প্রফেসর ইউনূসকে স্বাগত জানান জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মহাপরিচালক কু ডংইউ।
এদিন প্রধান উপদেষ্টা রোমে এফএও সদর দপ্তরে ব্রাজিলের কৃষিবিদ এবং লেখক হোসে গ্রাজিয়ানো দা সিলভার সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আজ ইতালির রোমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামের (ডব্লিউএফএফ) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য দেবেন। রোমের সময় দুপুর ২টায় (বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টা) এ বক্তৃতা দেওয়ার কথা রয়েছে তাঁর।
রোমে কর্মসূচি অনুযায়ী অধ্যাপক ইউনূস মূল বক্তব্য দেওয়ার পর গ্লোবাল অ্যালায়েন্সের অফিস পরিদর্শন করেন। বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার সঙ্গে তিনি বৈঠতে মিলিত হন। এছাড়া রোমের মেয়র রবার্তো গুয়ালতিয়েরির সঙ্গে বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে এবং জিবুতির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। তার দিনশেষের কর্মসূচি অনুযায়ী, সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে এফএও মহাপরিচালক ড. কু দোংইউ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।