গণভোটের সময় নিয়ে দলগুলো একমত হতে পারেনি
জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ আগামী ১৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় স্বাক্ষরিত হবে। এই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করবেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ ভবনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কার্যালয়ের সভাকক্ষে কমিশনের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করা হয়। সভায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কমিশনের ৫টি বৈঠকে প্রাপ্ত মতামত বিশ্লেষণ করা হয়। বৈঠকে আশা প্রকাশ করা হয় যে, বিশেষজ্ঞগণ এবং রাজনৈতিক দলসমূহ থেকে প্রাপ্ত অভিমতসমূহ বিশ্লেষণ করে খুব শিগগিরই বাস্তবায়নের উপায় সংক্রান্ত সুপারিশ এবং চূড়ান্তকৃত জুলাই সনদ সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে।
বৈঠকে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড.ইফতেখারুজ্জামান, ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও সভায় অংশ নেন।
জুলাই সনদের ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে ২৯টি নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা হবে। ২১টি রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এবং ৩৪টি প্রস্তাব বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত ধারার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিনের মতভিন্নতা কাটিয়ে উঠলেও সময়ের ব্যাপারে তারা একমত হতে পারছে না।
এদিকে গণভোটের সময় নিয়ে শেষ দিন বৃহস্পতিবারও দলগুলো একমতে আসতে পারেনি। বিএনপি চায় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট। জামায়াতে ইসলামী চায় আগামী নবেম্বরে গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন। আর সনদের ভিত্তিতেই হবে ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন। ফলে এ বিষয়ে কোনো ধরনের ঐকমত্য ছাড়াই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শেষ হয়। এ অবস্থায় আজকের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নে সরকারের কাছে সুপারিশ করবে ঐকমত্য কমিশন।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যখনই হোক ব্যালটে গণভোটের দুইটি অংশ থাকবে। সনদের যে সব প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে, সেগুলো নিয়ে একটি প্রশ্ন। আবার যে সব প্রস্তাবে কোনো দল নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) দিয়েছে, সেগুলো থাকবে আলাদা। ভোটাররা সেখানে দুইটিতেই আলাদাভাবে ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ ভোট দিতে পারবেন।
বৈঠক শেষে সমাপনী বক্তব্যে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের জানান, দিনভর আলোচনার সারসংক্ষেপ আমরা সংগ্রহ করেছি। এখন বিশেষজ্ঞদের মতামতের আলোকে সরকারকে একটি সুস্পষ্ট পরামর্শ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তিনি জানান, বিশেষজ্ঞরা সর্বসম্মতভাবে পাঁচটি প্রস্তাব দিয়েছেন। সেগুলো হলো-জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটি বিশেষ আদেশ জারি করতে হবে; ওই আদেশের মাধ্যমেই গণভোট আয়োজন করতে হবে; গণভোটে দুটি আলাদা প্রশ্ন রাখতে হবে, যাতে ঐকমত্য ও মতবিরোধ-উভয় বিষয় স্পষ্ট হয়; নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও ১৩তম জাতীয় সংসদ গঠন করতে হবে; গণভোটে অনুমোদনের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জুলাই সনদে বর্ণিত সংস্কার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
কমিশনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দুটি প্রস্তাব উঠে আসে। একাধিক দল জাতীয় নির্বাচনের দিনই পৃথক ব্যালটে গণভোট নেওয়ার পক্ষে আর কয়েকটি দল নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দেয়। তবে কমিশনের মতে-সবাই একমত যে, সংসদকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের কাঠামোগত পরিবর্তনের ক্ষমতা দেওয়া উচিত। অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আমরা আগামী এক-দুই দিনের মধ্যে চূড়ান্তভাবে মতামত সমন্বয় করে সরকারকে পরামর্শ দেব। পাশাপাশি অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল ও জোটকে অবহিত করা হবে।
তিনি আরো জানান, কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে ১৫ অক্টোবর। এর মধ্যে তারা জুলাই সনদের ওপর একটি স্বাক্ষরদান অনুষ্ঠান আয়োজন করতে চান। এর আগে জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট দেওয়ার পক্ষে মত তুলে ধরে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনের অল্প সময় বাকি আছে। এর আগে গণভোটের মতো মহাযজ্ঞ আয়োজন করা সম্ভব নয়। এতে অতিরিক্ত অর্থও খরচ হবে। তারা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করার প্রস্তাব জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রয়াস হবে।
সনদের অঙ্গীকারে একটি বিষয় যুক্ত করতে হবে-যেসব দলের যে যে বিষয়ে ভিন্নমত আছে, সেগুলো তারা নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করবে। জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হলে সে দল তাদের ভিন্নমত অনুসারে প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে পারবে। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই জাতীয় সনদের গাঠনিক ক্ষমতা জনগণের কাছ থেকেই আসবে এবং সে ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যম হবে গণভোট। তার মতে, গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যদি সনদ অনুমোদন করে, তাহলে পরবর্তী সংসদের দায়িত্ব হবে সনদের ঘোষিত দফাগুলো বাস্তবায়ন করা।
তিনি বলেন, গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যে অনুমোদন দেবে, সেটাই সংসদের ওপর বাধ্যতামূলক ম্যান্ডেট তৈরি করবে। তবে তিনি স্পষ্ট করেন, এর মানে এই নয় যে, ভবিষ্যৎ সংসদ অন্য কোনো সংস্কার করতে পারবে না, তবে জুলাই সনদের ধারাগুলো অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংসদের প্রথম অধিবেশনের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা দিলে তা বাস্তবে জটিল হতে পারে। তিনি প্রস্তাব দেন-‘যথাশীঘ্র সম্ভব’ বাক্যটি উল্লেখ করে সংসদকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে, যাতে নিয়ম পরিবর্তন ও আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়। তিনি আরো বলেন, আপার হাউস গঠন বা সেকেন্ড হাউস প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সনদ গৃহীত হওয়ার পরই বিবেচনা করা যেতে পারে।
নোট অব ডিসেন্ট প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ভিন্নমত বা আপত্তি থাকলেও তা জুলাই সনদের অংশ হিসেবেই গণভোটে যাবে এবং ভবিষ্যতে কোনো দল জনগণের ম্যান্ডেট পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে।
তিনি বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে এবং সে প্রজ্ঞাপনের ভিত্তিতেই গণভোট আয়োজন করা হবে। গণভোট আইন বা অধ্যাদেশে উল্লেখ থাকবে যে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের সম্মতি নেওয়া আবশ্যক। প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের মধ্যে আলোচনা করে গণভোটের বিধিবিধান নির্ধারণ করা হবে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধি দলের সদস্য সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোটেট শিশির মনির বলেন, বিশেষ সংবিধান আদেশ বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের প্রয়োজন আছে। এ আদেশে গণভোটের কথা বলা থাকবে। তফসিলে জুলাই সনদ থাকবে। আদেশের ভিত্তিতেই গণভোট হবে। আগামী সংসদের দুটি ক্ষমতা থাকবে-একটি সাধারণ সংসদের ক্ষমতা, অন্যটি কনস্টুয়েন্ট পাওয়ার বা গাঠনিক ক্ষমতা। সংসদের প্রথম অধিবেশনে এ ক্ষমতা থাকবে। দ্বিতীয় অধিবেশন থেকে সাধারণ সংসদ কাজ করবে। এভাবে হলে সংস্কার টেকসই হবে। তিনি বলেন, যে কয়টি বিষয়ে ভিন্নমত আছে, সেগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো না হলে সংস্কার মুখ থুবড়ে পড়বে। তিনি বলেন, গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে হতে হবে। এখন সিদ্ধান্ত নিলে আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে গণভোট করা সম্ভব।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, সংস্কারগুলো আগামীতে প্রশ্নবিদ্ধ হবে বা বাতিল হবে, এমন প্রক্রিয়ায় যাওয়া ঠিক হবে না। টেকসই করার বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ নামে একটি আদেশ দেওয়া উচিত। জুলাই সনদ বাস্তববায়ন করা হবে কি না-এ প্রশ্নে গণভোট দেওয়া এবং আগামী সংসদকে বিশেষ কনস্টুয়েন্ট পাওয়ার দেওয়া লাগবে। কারণ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোয় হাত দেওয়া হচ্ছে। এজন্য সংসদকে বিশেষ ক্ষমতা দিতে হবে। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট হতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট হলে গুরুত্ব হারাবে।