গুমের পর ক্রাসফায়ার ও গুলি করে নদীতে ফেলে হত্যার আগে অমানসিক নির্যাতন করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করা হতো। ইনজেকশন পুশ, ওয়াটার বোর্ড (গরম পানি ঢালা) করা হতো। অশ্লীল ভাসায় গালি ধেয়া হতো। মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলে রাখা হতো। কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত জানতে চেয়ে জোরে আঘাত করা হতো। গুম কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য। প্রতিবেদনে গুম হওয়া একজনকে জিজ্ঞাসাবাদের ধরণ এবং সেসময়ে কি ধরণের আচারণ করা হয়েছে তা তুলে ধরা হয়েরেছ।

G2_20250705_180147544

জিজ্ঞাসাবাদের সময় বলা হয়, “বল, তুই জামাতের? তুই শিবিরের? তুই কি করস?” আমি বলছি যে, “দেখেন, আমি এক সময় ছাত্র শিবির করতাম, এখন আমি করি না। আমি এটা অনেক আগেই ছেড়ে দিছি, ২০১৪ সালের পর থেকে আমি কোন রাজনীতি করি না। আমার বাবা মারা যাওয়ার, ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে আমি আসলে পড়াশোনা করে একটা চাকরি নেওয়ার চেষ্টা করছি।” এই নানান প্রশ্ন। “তুই কেন ফজরের নামাজ জামাতে পড়স? মেয়েদের সাথে তোর কোন রিলেশন নাই কেন?” এই সব ওয়াটার বোর্ড (গরম পানি ঢালা) করার মাঝে মাঝে এটা জিজ্ঞেস করে। ওইটা থামায় থামায় কোশ্চেন গুলো করতেছে। ..... আমার মনে হয় দুই মিনিট পর আমি সেন্সলেস হয়ে যাই। সর্বশেষ শুধু একটা গালি শুনছিলাম যে, “রাজাকারের বাচ্চা”। এরপর আমার হুশ ছিল না। এরপর আমি বেহুশ হয়ে গেছিলাম।

জিজ্ঞাসাবাদের সময় প্রশ্ন করত আমার কেন গার্লফ্রেন্ড নাই? তখন আমার মুখে আরেকটু বড় দাড়ি ছিল-“কেন মুখে বড় দাড়ি? টাকনোর উপর কেন প্যান্ট পড়ি?” এই নানান কোশ্চেন। “আমার ভাই কেন জামাতে ইসলামী করত?” তো এগুলো বলছে, আর ফাঁকে ফাঁকে উনি খুবই বাজে গালি দিত। ... আমি জাস্ট কান্না করতেছিলাম আর বলতেছিলাম, “স্যার আমি মিথ্যা কিছই বলতেছি না। আপনি আমার কথা বিশ্বাস না হইলে আমার এলাকায় যাইয়া খবর নিয়ে দেখেন।

আমি মিথ্যা কিছু বলতেছি না। আমি সবই সত্য বলতেছি। আমি এক সময় শিবির করতাম, এখন শিবির করি না, স্যার। আমার ভাই জামাত করতো, সে মারা গেছে। আর আমার পরিবারের অন্য কেউ জামাত-শিবিরের সাথে সরাসরি নাই।” তখন বলছে, “না, তোর বাপেও জামাত করছে।” আমি বলছি, “না, বাবা কখনো জামাত করে নাই। সে ইসলাম প্রিয় মানুষ ছিল, ধর্ম-কর্ম মানতেন। আমার পরিবার ধর্ম-কর্ম করে, তারা জামাত করে না। আমি শিবির করছি, ভাইয়া জামাত- শিবির করছে।” আরো দুইটা জিনিসে খুব ফোকাস করছে। আমরা সাত-আট জন মিলে রোহিঙ্গাদের হেল্প করার জন্য একটা টিম করে গেছিলাম। আর কোন কিছু না। তো ওইখানে কেন গেছিলাম? তাদেরকে কেন হেল্প করছি? আর ভারত-পাকিস্তান। আমার কোনটাকে ভালো লাগে, এই টাইপের। ... প্রশ্নটা বলছে যে, “তোর কি ভারত ভালো লাগে? বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কাদেরকে ভালো লাগে? বাংলাদেশকে স্বাধীন ভালো লাগে?”... তারপর বলছে যে, “রোহিঙ্গাদেরকে তোরা হেল্প করতে গেছস। তোরা আসলে কী চাস? রোহিঙ্গাদেরকে তোরা কি এই দেশে রাখবি? রাইখা দিতে চাস, নাকি ফেরত দিতে চাস? রোহিঙ্গাদেরকে তোরা কি এরকম তোর জামাত-শিবিরের মত জঙ্গী বানাবি? তোদের চিন্তা-ভাবনা কি?” আমি বলছি যে, “দেখেন, আমার এই ব্যাপারে কোন চিন্তা-ভাবনা নাই। ওদের কষ্ট দেখে আমরা জাস্ট একটা টিম করে টাকা- পয়সা কালেক্ট করে ওদেরকে হেল্প করছি। ওদেরকে আসলে কোন কিছু বানানো বা ইসলামী মানুষ বানানো, এরকম আমার কোন চিন্তা ছিল না।” এই জিনিসগুলো নিয়ে ফোকাস করছে বেশি। আর জামাতের-শিবিরে আমি কোন পদে আছি? কি করি?

G3_20250705_180124180

প্রতিবেদনে আর একজনের জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে জানা যায়, তারা বুঝায় দিল যে, “আমরা সব আপনার সম্বন্ধে জানি।” আমি বিএনপি করি। ম্যাডামের সাথে চলি। এগুলো সবই তারা জানে। “আপনি আমাদেরকে আগে বলেন, আপনি বেগম খালেদা জিয়ার জন্য কি করতেন?” আমি পার্টি করি। আমাকে যখন যে টাস্ক দেওয়া হয়, আমি টাস্কটা ফলো করি। .... ওরা জিজ্ঞেস করছে: “উনার সেফটি সিকিউরিটিতে কোন কোন দেশ ইনভলভ? কারা তাকে সহযোগিতা করে?” আমি বলেছি, “আমি জানি না।“ তো যখন বলছি জানি না, তখন বলল যে, “দেখেন, আপনি যত আমাদের সাথে নন-কোঅপারেশন করবেন, আপনার জন্য দিন তত খারাপ হবে।” তখন বলল যে, “আপনি এম্বাসিগুলাতে যেতেন। এম্বাসি থেকে গিফট আসতো। উনি গিফট দিত। এগুলা গিফটে কি ছিল?” আমি বললাম, “আমি জানি না।”

তখন মনে আছে, একটা জোরে-মানে হাতুড়ি না কি দিয়ে বাড়ি মেরেছে জানি না, মানে আমার হাঁটুর মধ্যে। আমার তখন গলায় আওয়াজ আটকে গেছে পুরা। মানে এত জোরে লেগেছে, আমি তখন আর কথা বলতে পারছিলাম না। তো পাশ থেকে আরেকজন ইয়াং অফিসার তখন চিল্লাচ্ছে, “স্যার, একে শেষ করে ফেলি! এই করে ফেলি, ওই করে ফেলি!” তো অন্যজন বলছে, “না, মুখ খুলবে। কয়দিন বন্ধ রাখবে?” তো তখন, ওইদিন ওখানে শেষ।

দুই-তিন দিনের মাথায় আবার হুট করে নিয়ে গেল। নিয়ে গিয়ে আবার শুরু করল, “আচ্ছা, আপনার সাথে তো ওইদিন এই কথা হয়েছিল। আপনি কি এখন রেডি বলার জন্য?” আমি বললাম, “আমি কিছু জানি না।” তো বলছে, “তারেক রহমানের একাউন্ট ডিটেইল বলেন -কোন কোন জায়গায় তার টাকা থাকে।” আমি বললাম, “ভাই, আমি জানি না। আই ডোন’ট নো। সিম্পলি ডোন’ট নো।” তো বলছে, “ম্যাডাম জিয়ার টাকা কোথায় দিয়েছেন? কোথায় রাখেন?” আমি বলি, “আমি জানি না।” তখন আবার দিল-আমার দুইটা নি ক্যাপ, মানে তারা আবার বারি দিল। তারপর ফেলে রাখলো। তাদের মূলত কথা ছিল দুইটা জিনিস - বেগম খালেদা জিয়ার একাউন্ট কোথায় কোথায়? তারেক রহমান সাহেবের একাউন্ট কোথায় কোথায়? বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে কোন কোন দেশ থেকে সহযোগিতা করে বা করে কিনা, কারা করে? এগুলা জানতে চায়। আমারে চিৎ করে শোয়ায় দিছে। দিয়ে দুই হাতের মধ্যে আর দুই পায়ের মধ্যে বাঁশ ঢুকায় দিছে। তারপর হাত-পায়ের উপরে চারজন উঠে বসে। এরপর মুখের উপরে একটা কাপড় দিয়ে উপর থেকে পানি ঢালতেছিল। যেটাকে আমি কিছু বই পুস্তকে পড়ছিলাম। এর নাম হবে ওয়ারটার বোর্ডিং। তো ওই মাইরটা আমি নিতে পারতেছিলাম না। আমার মনে হয় যে যে কোনো সেকেন্ডের মধ্যে আমি মারা যাবো, আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। তো ওরা মনে হয় হার্ট চেক করতেছিল যে হার্ট বন্ধ হয়ে যায় কিনা। দুই-আড়াই মিনিট, তিন মিনিট এইটা দিছে।

G4_20250705_180042692

আরেক ভুক্তভোগীর বাবা বলেছেন: [গুম পরবর্তীতে থানায় যেয়ে] “পরে দূর থেইকা দেখলাম, কথা বললাম, কাছে গেলাম। হে আমারে চিনলো, খালি হাসে, আর কিছুই কয় না।” আমি জিগাইলাম, “এই যে তোর নখগুলা কই গেল? হাত দেখা তো, পা দেখা।”দুই পায়ের নখ নাই। হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের দুইটা নখও নাই। আগেত এমন আছিল না। আমি জিগাইলাম, “এই কী হইছে?” সে কিচ্ছু কইতে পারলো না। শুধু কইলো, “বলা যায় না।” ঠিক বুঝতে পারি না, কিন্তু আমি চোখে দেখি - নখ নাই, দুই পায়েরও নাই। আমি আবার জিগাইলাম, “স্যার, আমার ছেলেটারে কই থেইকা আনছেন?” তারা কয়, “র্যাব হেফাজতে ছিল, সেখান থেইকা দেওয়া হইছে।” আমি কইলাম, “আমার ছেলে তো দুই বছর ধইরা নিখোঁজ। এতদিন পরে কইরতে আনছেন? আগে কই আছিল?” তারা কয়, “আপনার ছেলের মামলা দিয়া ছিল।” আমি কইলাম, “মামলা যদি দিয়া থাকে, এতদিন পর কেন আনছেন?” ওনারা কয়, “আপনার এত বাড়াবাড়ির দরকার নাই।” আমি কইলাম, “ভাই, আপনি যদি সহজ করে কইতেন, আমি তো সব শেষ মানুষ। আমার বউ মরে গেছে, ছেলে হারা হইছিলাম।” এতদিন পর যদি পাইলাম, তাহলে আগে জানাইলে আমি জামিনও নিতে পারতাম। আমি তো কিচ্ছু বুঝি না। তারা কয়, “উকিলের লগে যান, সব বুঝাই দিমু।” আমি কইলাম, “দোষটা কী? আমি তো শুধু অভিযোগ দিছি, ছেলে নিখোঁজ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়া নিছে।” দুই বছর পরে পাইছি। কয় কাগজ দেখাইলে বুঝা যাবে মামলার অবস্থা।

ভুক্তভোগী ছেলে বলেছেন, সেলের ভিতরে থাকতাম, ওয়াশরুমে যাইতাম – ওই সময় মাইর খাইতাম, লাঠি দিয়া। খুব কান্না করতাম, ব্যথা পাইতাম। মনে হইতো বাড়ি যাই। কিন্তু বইলা দিত, “দিন হইছে শুয়ে থাক, রাত হইছে ঘুমা, কথা বলবি না, আওয়াজ করবি না।” . আইনের লোক আছিল, কিন্তু ওই জায়গায় কোনো বন্ধু ছিল না। একা আছিলাম। অফিসার আইতো, জিগাইতো নাম, খাবার কি, অসুস্থ লাগলে কইতে। কয়, “কান্না করিস না, কষ্ট হইলে বলিস।” এখন কষ্ট পাই না, কিন্তু তখন ভিতর থেইকা খুব কষ্ট পাইতাম। যখন বাড়ি আসলাম, খুব ভালো লাগলো। মনে হইলো দুনিয়া পাইলাম। ভুক্তভোগী ছেলে বলেছেন, সেলের ভিতরে থাকতাম, ওয়াশরুমে যাইতাম-ওই সময় মাইর খাইতাম, লাঠি দিয়া। খুব কান্না করতাম, ব্যথা পাইতাম। মনে হইতো বাড়ি যাই। কিন্তু বইলা দিত, “দিন হইছে শুয়ে থাক, রাত হইছে ঘুমা, কথা বলবি না, আওয়াজ করবি না।” . আইনের লোক আছিল, কিন্তু ওই জায়গায় কোনো বন্ধু ছিল না। একা আছিলাম। অফিসার আইতো, জিগাইতো নাম, খাবার কি, অসুস্থ লাগলে কইতে। কয়, “কান্না করিস না, কষ্ট হইলে বলিস।” এখন কষ্ট পাই না, কিন্তু তখন ভিতর থেইকা খুব কষ্ট পাইতাম। যখন বাড়ি আসলাম, খুব ভালো লাগলো। মনে হইলো দুনিয়া পাইলাম।