অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এনায়েতের কাছ থেকে দেশের কয়েকজন রাজনৈতিক দলের নেতা, উচ্চ পদস্থ দুই পুলিশ কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালী কয়েকজন আমলার সংশ্লিষ্টতা পেয়েছেন বলে জানা গেছে। একটি নতুন রাজনৈতিক দলের একাধিক নেতা ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং দলটির ঘনিষ্ঠ অন্য একটি দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতার নাম পাওয়া গেছে। এনায়েতের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করছেন গোয়েন্দারা। তার তথ্যের সাথে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে প্রভাবশালী কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হতে পারে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে এই মুহূর্তেই কাউকে গ্রেফতার না করে তদন্তের গভীরে যেতে চাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদে যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন। বিষয়টি র্স্পর্শ কাতর হওয়ায় এবং গ্রেফতার এনায়েতের মার্কিন নাগরিত্ব থাকায় স্বচ্ছতার সাথে সামনে অগ্রসর হচ্ছে পুলিশ।
অন্য একটি দেশের এজেন্ট হিসেবে কাজ করার অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গ্রেফতার ‘রহস্যমানব’ এনায়েত করিম চৌধুরী ও তার প্রধান সহযোগী গোলাম মোস্তফা আজাদ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বর্তমানে পাঁচ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার ঢাকা মেট্রোপলিটন মাজিস্ট্রেট সারাহ ফারজানা হকের আদালত উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে রিমান্ডের আদেশ দেন। এদিন এনায়েত ও তার সহযোগীকে আদালতে হাজির করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আখতার মোর্শেদ ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। রাষ্ট্র পক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। আসামীপক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরআগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর এনায়েতকে গ্রেফতার করে বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় কারাগারে পাঠায় আদালত। জিজ্ঞাসাবাদে সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, আমলা, ব্যবসায়ী ও একাধিক দলের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে এনায়েত করিম চৌধুরীর যোগাযোগ, বৈঠক ও সখ্যের তথ্য পাওয়ায় সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ের জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জিজ্ঞাসাবাদে আসামী জানান, বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকার খুব নাজুক অবস্থায় আছে এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই বর্তমান সরকারকে পরিবর্তন করে নতুন জাতীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে কাজ করার জন্য বাংলাদেশে এসেছেন। পরবর্তীতে গুলশানে অবস্থান করতে থাকেন। ইতোমধ্যে তিনি সরকারি উচ্চ ও নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা, ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছেন। গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এনায়েতের সঙ্গে যাদের যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে তাদের ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে খোঁজখবর করা হচ্ছে। এসব যোগাযোগ বা সাক্ষাৎ নিছকই সখ্য বা সৌজন্যতা নাকি এর নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ আছে, এখন সেগুলোই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ডিএমপির ডিবির রমনা জোনাল টিমের পরিদর্শক আক্তার মোর্শেদ বলেন, এনায়েত করিমের সঙ্গে একাধিক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, আমলা ও ব্যবসায়ীর যোগাযোগ ছিল। তিনি নিজেকে মূলত একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট দাবি করলেও প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে তিনি একজন মধ্যস্থতাকারী। তবে তার কাছ থেকে নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
এনায়েত করিম চৌধুরীকে গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন নিয়ে বহু বছর ধরে ব্যস্ত থাকা চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে দলগঠনে সহায়তা করেছেন এনায়েত। তাকে রাজনীতির পথে ধাবিত করেন বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট দাবি করা এনায়েত করিম চৌধুরী। তিনি নতুন রাজনৈতিক দল ‘জনতা পার্টি বাংলাদেশ’কে অর্থায়ন করেন। নতুন দলের জন্য তিনি ইলিয়াস কাঞ্চনকে নিয়মিত অর্থও জোগান দিতেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ইলিয়াস কাঞ্চন ও তার নবগঠিত দলের সঙ্গে এনায়েতের যোগাযোগের সত্যতা রয়েছে। দল গঠনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এনায়েত এই দলে প্রতি মাসে সাড়ে ৩ লাখ করে টাকা দিতেন। এনায়েতকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, এনায়েত বর্তমান সরকারকে পরিবর্তন করে নতুন জাতীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মিশন নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে অবস্থান করে ইতোমধ্যে সরকারি উচ্চ ও নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা ও ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছেন। এ ব্যাপারে ইলিয়াস কাঞ্চনের মোবাইলে ফোন করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে একজন ডিআইজির সঙ্গে যোগাযোগের বিষয় আলোচিত হলেও মূলত এনায়েতের সঙ্গে দুজন ডিআইজির যোগাযোগ ও সখ্যের তথ্য পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তাদের মধ্যে একজন ৬ সেপ্টেম্বরে এনায়েত করিমকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে যান। আরেকজনের সঙ্গে ঢাকায় আসার পর তার সাক্ষাৎ হয়। জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা আরও বলেন, এনায়েতের সঙ্গে একজন প্রভাবশালী আমলার গভীর যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে। এই আমলার নামে দুদকের বেশ কিছু মামলা আছে। সেসব মামলা থেকে তাকে অব্যাহতি পাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে নানা সময় তাদের কথাবার্তা, যোগাযোগ ও বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। মামলা থেকে বাঁচানো বা রক্ষা করার কথা বলে দেড়শ কোটি টাকার চুক্তি হয় তার সঙ্গে। তবে টাকা লেনদেনের কোনো প্রমাণ এখনো হাতে পাওয়া যায়নি। এনায়েতের সহযোগী গ্রেফতার মোস্তফা আজাদ একাত্তর টিভিতে জিএম অপারেশন হিসাবে কাজ করতেন। ৫ আগস্টের পর তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে ইস্তফা নেন। তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তাকে ২ লাখ টাকা বেতনে নিজের সহকারী হিসাবে রেখেছিলেন এনায়েত করিম। মোস্তফার মাধ্যমে এনায়েত তার টাকা বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতেন। গুলশানে যে বাড়িতে এনায়েতের থাকার কথা, সেই বাড়িতে থাকতেন মোস্তফা আজাদ। এই বাড়ি ভাড়ার জন্যও মাসে ২ লাখ টাকা দিতেন এনায়েত।
মামলার সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর মিন্টো রোডের মন্ত্রীপাড়া এলাকায় প্রাডো গাড়িতে করে সন্দেহজনক চলাচল করতে দেখা যায় আসামী এনায়েত করিম চৌধুরীকে। এসময় তার গাড়ি থামানো হয় এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি কোনও সদুত্তর দিতে না পারায় তাকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। তার কাছে প্রাপ্ত ২টি আইনফোন জব্দ করা হয়। তার ফোন বিশ্লেষণ করেও বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে দাবি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। প্রভাবশালী একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্ট দাবি করা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ থাকা ব্যক্তিদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা। ৪৮ ঘণ্টার রিমান্ড শেষে আরও বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একজন সহযোগীসহ তাকে নতুন করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এরআগে গত ৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে নিউইয়র্ক থেকে কাতার এয়ারওয়েজ যোগে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তিনি।