ঢাকায় হাইকোর্টের সামনে প্লাস্টিকের ড্রামের ভেতর থেকে আশরাফুল হক নামে এক যুবকের খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে পুরান ঢাকায় মামুন নামে এক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে প্রকাশ্যে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এর কয়েকদিন আগে একই এলাকায় এক ছাত্রদল নেতাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার কয়েকদিন আগে বিমানবন্দর স্টেশনে একটি ট্রেনের বগি থেকে বিপুল পরিমাণ অবৈধ আগ্নেয়াঅস্ত্র উদ্ধার করে সেনাবাহিনী।
এরই মাঝে জুলাই-আগস্টে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভারতে পলাতক শেখ হাসিনার মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রাজধানী ও আশেপাশের এলাকায় অগ্নি সন্ত্রাস চালাতে শুরু করে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এছাড়াও ককটেল বিস্ফোরণ ও নৃশংসতা চালিয়ে মানুষকে হত্যা করছে ফ্যাসিস্ট সমর্থিতরা। হাসিনাসহ তিন আসামির মামলার রায় আগামি ১৭ নভেম্বর ঘোষণার তারিখ ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ফ্যাসিস্ট সর্মথিতরা সারাদেশে চোরাগোপ্তা অগ্নিসন্ত্রাস অব্যহত রেখেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার মাঝেও যানবাহনে আগুন দিয়ে নিজেদের তৎপরতা জানান দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে নিষিদ্ধ দলের নেতা-কর্মীরা। অভিযোগ রয়েছে- টাকার বিনিময়ে লোক ভাড়া করে এ ধরণের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে তারা।
অনেকেই মন্তব্য করছেন, অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকাসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার পর এর তেমন উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বরং দিনে দিনে অবনতির দিকে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি প্রভৃতি অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অভিযানে গিয়ে পুলিশ হামলার শিকার হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই পরিস্থিতি তপ্ত হচ্ছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীরা সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। এ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকরাও চিন্তিত। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে, রাজনৈতিক অঙ্গনে ও জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। পুলিশ সদর দপ্তরে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। গত সপ্তাহে আইজিপির নেতৃত্বে ঊর্ধ্বতনরা বিশেষ বৈঠক করেছেন। ওই সভায় কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। এদিকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বেড়ে যাওয়ায় আগ্নেয়াস্ত্র বহনকারী এবং অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের দেখামাত্র ব্রাশফায়ার করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ। মঙ্গলবার রাতে সিএমপি কমিশনার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, দুপুরে ওয়্যারলেস সেটে সিএমপির সব সদস্যদের উদ্দেশে দেওয়া এক মৌখিক আদেশে তিনি টহল ও থানা পুলিশকে একযোগে এ নির্দেশনা দেন।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হওয়ায় উল্লিখিত বৈঠকে বিশদ আলোচনা করেছেন পুলিশ কর্তারা। কী কারণে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাই বেশি উত্তাপ ছড়িয়েছে পুলিশে। যারা অবনতি ঘটাচ্ছে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুলিশের ইউনিট প্রধান, রেঞ্জের ডিআইজি, জেলার পুলিশ সুপার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে গত বৃহস্পতিবার রাতে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। অপরাধ সংঘটনপ্রবণ এলাকায় প্রাথমিক তদন্তে যদি দেখা যায় পুলিশের দায়িত্ব পালনে অবহেলা ছিল, তাহলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য বা ইউনিটের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের জবাবদিহি করতে হবে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরও পুলিশ পুরো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ডেভিল হান্টসহ বিভিন্ন সাঁড়াশি অভিযান চালানো হলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। ডাকাতি, ছিনতাই, খুন, দস্যুতা, পাশবিক নির্যাতন, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, পুলিশের ওপর আক্রমণ, মাদক কেনাবেচা, চোরাচালান, চুরি প্রভৃতি অপরাধ বেড়েছে। তবে এসব ঘটনায় আসামি গ্রেপ্তার হচ্ছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় হত্যা মামলার আসামি ও দাগি অপরাধীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। আওয়ামী লীগ এবং সুহৃদ ও অঙ্গ সংঠনের নেতাকর্মীদের, পুলিশ কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৩০টির বেশি মামলার চার্জশিট দিয়েছে তদন্তকারী সংস্থাগুলো।
জানা গেছ, সাম্প্রতিককালে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে পুলিশে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি ঘটাতে এবং মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম ঢেলে সাজাতে ইতিমধ্যে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও দপ্তরে বিশেষ চিঠি পাঠানো হয়েছে। পুলিশের বার্তায় বলা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে তল্লাশিচৌকি বাড়াতে হবে; অপরাধপ্রবণ এলাকায় টহল বাড়াতে হবে; সেনাবাহিনী, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও বিজিবি সদস্যদের সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী গঠন করে টার্গেটকৃত এলাকায় জোরালো অপারেশন চালাতে হবে; গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অতিরিক্ত প্যাট্রল ডিউটি করতে হবে; পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটপ্রধান, উপপুলিশ কমিশনার, সেনাবাহিনীর মাঠে নিয়োজিত ব্রিগেডপ্রধান ও অন্যান্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের প্রতিটি ঘটনায় সমন্বিত তৎপরতা চালাতে হবে; পুলিশ, বিজিবি, আনসার ও কোস্ট গার্ডের সদস্যদের জন্য মোটরসাইকেল কেনা হবে যাতে তাৎক্ষণিকভাবে অলিগলিতে টহল দিয়ে অপরাধীদের পাকড়াও করা যায়; ছিনতাইকারী ও ডাকাতরা অবস্থান করতে পারে এমন সম্ভাব্য স্থানে সমন্বিত অভিযান চালাতে হবে; থানাভিত্তিক সন্ত্রাসীদের হালনাগাদ তালিকা করে তাদের আইনের আওতায় নেওয়ার ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে; মিথ্যা, গুজব ও প্রোপাগান্ডার বিপরীতে সত্য তথ্য প্রচারে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রনে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আরও সাড়ে তিন মাসের জন্য বাড়িয়েছে সরকার। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামি ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে। এরআগে এই ক্ষমতা ৬০ দিনের জন্য দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। এদিকে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের জেলায় সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১২ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানান, ঢাকা ও আশপাশের জেলার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এরআগে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে শাহ আলীর বেড়িবাঁধ এলাকায় বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দুই দুর্বৃত্ত পার্কিং করা কিরণমালা বাসে আগুন লাগিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় স্থানীয়রা টের পেয়ে ধাওয়া দিয়ে একজনকে আটক করে। অন্যজন পালাতে গিয়ে তুরাগ নদীতে ঝাঁপ দেয়। পরে তাকে মুমূর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে বাসের ভেতরের আসন ও জানালার গ্লাস পুড়ে গেছে। শাহ আলী থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আটকদের পুলিশে হস্তান্তর করা হয়েছে।
গত সোমবার গভীর রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে দুটি এবং উত্তরায় একটি বাসে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এছাড়া মঙ্গলবার রাতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় পরিত্যক্ত একটি প্রাইভেট কারে আগুন লাগে। এর আগে মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আরও তিনটি বাসে আগুন লাগার খবর পাওয়া যায়। আর মঙ্গলবার সূত্রাপুরে ফায়ার সার্ভিসের গেটের সামনে মালঞ্চ পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। অন্যদিকে, মঙ্গলবার রাজধানীর উত্তরার জসীম উদ্দীন রোড ও মৌচাক মার্কেট এলাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে দুর্বৃত্তরা ককটেল নিক্ষেপ করে। এ ঘটনায় পুলিশের একজন সার্জেন্ট আহত হন। আর রাতে ধানমন্ডিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) কার্যালয়ের সামনে একটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
কয়েকটি আলোচিত ঘটনা : বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজশাহী মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আবদুর রহমানের ভাড়া বাসায় ঢুকে ছেলে তাওসিফ রহমানকে (সুমন) ছুরিকাঘাত করে হত্যার ঘটনা ঘটে। হত্যার ঘটনায় আটক যুবক লিমন সম্প্রতি পরিবারটির সদস্যদের হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় ৬ নভেম্বর সিলেটের জালালাবাদ থানায় জিডি করেছিলেন বিচারকের স্ত্রী। দারোয়ানকে বিচারকের ভাই পরিচয় দিয়ে লিমন বাসায় প্রবেশ করে। এরআগে গত বুধবার রাজধানীতে আট ঘণ্টার ব্যবধানে মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাব্বির আহমেদ ও পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার সূর্যমনি ইউনিয়ন ছাত্রদলের সদস্য সৌরভের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গুলশান থেকে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় সৌরভ ও মোহাম্মদপুরের একটি বাসা থেকে সাব্বিরের লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ১৩ নভেম্বর এক তথ্যে জানা যায়, চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে তিন দিনের ব্যবধানে চারজনের লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটে। পরপর এসব ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়। এলাকার নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বাসিন্দারা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। এছাড়া চলতি বছর ৭ অক্টোবর রাতে খুলনা শহরের ২ নম্বর কাস্টমঘাট এলাকায় ইমরান মুন্সি নামের এক ব্যবসায়ীর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ৫ অক্টোবর রাতে কক্সবাজারের ঝিলংজা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী দুর্বৃত্তের গুলিতে গুরুতর আহত হন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশায় নিজ বাড়িতে গুলিবিদ্ধ হন তানভীর হাসান শুভ নামে এক তরুণ। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে ১০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে রাজীব চৌধুরী নামের এক ঠিকাদারকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। ১৬ সেপ্টেম্বর খুলনা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব শেখ আবু হোসেন বাবুর বাড়িতে গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ১১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শাহজাহানপুরের ঝিলপাড় এলাকায় সন্ত্রাসীদের দুই গ্রুপের সংঘাতে দুজন গুলিবিদ্ধ হন। ১০ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপের কালারমারছড়া এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। ৫ সেপ্টেম্বর মুন্সীগঞ্জ সদরের মোল্লাকান্দি ইউনিয়নে বিএনপির দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে আটজন গুলিবিদ্ধ হন। ২২ বছর কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার পর ১৩ আগস্ট হত্যা করা হয় চরমপন্থি নেতা শাহাদাত হোসেনকে; ক্ষুব্ধ হয়ে তার পরিবার মামলাই করেনি।