আজ পঁচিশে মার্চ মঙ্গলবার। ১৯৭১ সালের এই দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। এদিন রাতেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’র নামে বাংলাদেশে ইতিহাসের বর্বর ও গণহত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটায়। সেই বিভীষিকাময় ঘটনার কারণে পঁচিশে মার্চের রাতটি ‘কালরাত’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
দিবসটিকে যথাযোগ্য মর্যদায় পালনের উদ্দেশ্যে বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-- রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার বাণী প্রদান এবং সারাদেশের স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরিসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে ২৫ মার্চ গণহত্যার স্মৃতিচারণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া ঐ দিন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সকাল ১০টায় অথবা সুবিধাজনক সময়ে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ সকল সিটি করপোরেশনে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে এবং গৃহীত কর্মসূচি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার প্রচার করবে। এছাড়াও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের স্মরণে বাদ যোহর/সুবিধাজনক সময়ে সকল মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য উপাসনালয়ে প্রার্থনার আয়োজন করা হবে।
এছাড়া, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের লক্ষ্যে সারাদেশে রাত ১০টা ৩০ মিনিট হতে ১০টা ৩১ মিনিট ১ মিনিটের প্রতীকী ব্ল্যাক আউট (কেপিআই/জরুরি স্থাপনা ব্যতীত) পালন করা হবে। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি ভবন ও স্থাপনাসমূহে কোনো অবস্থাতেই ২৫ মার্চ রাতে আলোকসজ্জা করা যাবে না।
এদিন বেলা ১১টায় সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল টিক্কা খান, মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ এবং জেনারেল ওমর রংপুর যান। এ সময় ১৪ ডিভিশন সদর দফতরের জনৈক কর্নেলের হাতে একটি সিল করা প্যাকেট ছিল। রংপুর ২৩ ব্রিগেডের কমান্ডার আব্দুল আলী মালিক তাদের স্বাগত জানান। সেখানে একমাত্র ইপিআর বাঙালি প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন ওয়াজিশকে ছাড়া সকল ইউনিট কমান্ডারকে নিয়ে ব্রিগেডিয়ার মালিক বৈঠক করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে হেলিকপ্টার রংপুর ত্যাগ করে রাজশাহী, যশোর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা সেনানিবাস ঘুরে বিকেলে ঢাকা ফিরে এলো। বাইরে খবর ছড়িয়ে পড়ল পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান ইয়াহিয়ার অন্যতম প্রধান আলোচনাকারী এম আহমদ গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় প্রেসিডেন্ট হাউজ ত্যাগ করে ইয়াহিয়া খান সরাসরি করাচি চলে গেছেন। রাত পৌনে ৮টায় প্রেসিডেন্টের ঢাকা ত্যাগের কথা প্রথম জানা যায়।
এরই মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু পার্টিগুলোর নেতা ওয়ালী খান বলেন, বেজেঞ্জো এবং মিয়া মমতাজ দওলতানা ঢাকা ত্যাগ করেছেন। বিকেলে প্রেসিডেন্টের আইন বিষয়ক পরামর্শদাতা একে ব্রোহীও করাচিতে ফিরে যান। আগের দিন ২৪ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া দ্বি-পাক্ষিক আলোচনায় অগ্রগতি না হওয়ায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নয়া ফর্মুলার প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত প্রেসিডেন্সিয়াল ঘোষণা বাস্তবানের উদ্দেশে এবং প্রস্তাবিত বৈঠকে যোগদানের জন্য শেখ মুজিবের পরামর্শদাতারা এদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন। তাদের ধারণা ছিল ইয়াহিয়া এবং শেখ মুজিবের আনুষ্ঠানিক আলোচনা ব্যর্থ হয়নি।
বিভিন্ন প্রশ্নের বিস্তারিত আলোচনার জন্য যখন উভয়পক্ষে পরামর্শদাতাদের মধ্যে বৈঠক অব্যাহত রয়েছে, তখন নয়া ফর্মুলার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিকেলে ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠক হবে, কেননা বঙ্গবন্ধু ও প্রেসিডেন্ট পরামর্শদাতাদের বৈঠকে নতুন আবদার সৃষ্টি হয়েছে।
এদিন রাত সাড়ে ৯টায় তারা নির্বিচারে ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে, আরমানিটোলা, পিলখানার বিডিআর ক্যাম্পে হামলা চালায়। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, দৈনিক পত্রিকা অফিসে বোমা নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগ করে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে। অগ্নিসংযোগে সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে বোমাবর্ষণ ও ব্যাপকভাবে লুটপাট চালানো হয়। গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে বিমানে করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে একটি মিলিটারি কোর্টে তার বিচারের ষড়যন্ত্র শুরু করা হয়। সেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নির্মম স্মৃতি আজো জাতিকে পীড়া দেয়।
মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন পঁচিশে মার্চ রাত সর্ম্পকে লিখেছেন, সে রাতে ৭,০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হয় আরো ৩,০০০ লোককে। ঢাকায় এই ঘটনা ছিল কেবল শুরু। পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা চালিয়ে যায় হত্যাকা-। সেই সাথে তারা জ্বালিয়ে দিতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমিতে।
২০১৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত রণাঙ্গনের বীর সৈনিক লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী তার ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১’ গ্রন্থে এ দিনের নির্মমতার কথা তুলে ধরে বলেন, “২৫ মার্চ সকালে ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে ৪৫ মিনিটব্যাপী এককভাবে এক গোপন বৈঠক করেন। সারাদেশে জনতার উত্তাল তরঙ্গ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়লে সামরিক জান্তা নির্দ্বিধায় রংপুর, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে গুলী চালিয়ে কমপক্ষে ১২০ জনকে হত্যা করে বলে খবর পাওয়া যায়।