ডা.এম জি ফারুক হোসেন ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম এনডিএফ’র জয়েন্ট সেক্রেটারি এবং বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ তথা পিজি হাসপালের এসোসিয়েট প্রফেসর। জুলাই যুদ্ধে হতাহতদের সেবা দিয়েছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সেই দিনগুলোর কথা শুনিয়েছেন দৈনিক সংগ্রামের পাঠকদের। সাক্ষাতকার নিয়েছেন ইবরাহীম খলিল।
দৈনিক সংগ্রাম : জুলাই অভ্যুত্থানে আপনারা ডাক্তাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আন্দোলনে আহতদের মুক্তি দেওয়া, সুস্থ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকার তুলনা হয় না। আসলে কোনদিন থেকে আন্দোলনে আহতদের পাওয়া শুরু করেন ?
ডা. এম জি ফারুক হোসেন : আমরা ১৮ জুলাই থেকে বিপুল সংখ্যক রোগী পাই। তবে এর আগে থেকেই পুলিশ কর্তৃক আক্রান্তদের আমারা কিছু কিছু রোগী পাওয়া শুরু করি। প্রকৃতপক্ষে শুরু থেকেই আমরা স্বক্রীয় ভূমিকা পালন করি। যেহেতু পিজি হাসপাতালের সাথেই আমাদের ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম এনডিএফ’র অফিস। আমাদের কাছে প্রথম থেকেই খোঁজ খবর ছিল। বিশেষ করে ঢাকা মেডিকেল, অরোরা, ইসলামী ব্যংক হাসপাতাল, আশপাশের যত প্রাইভেট হাসপাতাল ছিল, সব হাসপাতালে যেখানেই আহত হয়ে এসেছেন আমাদের এনডিএফের সদস্যরা সাথে সাথেই চিকিৎসা দিয়েছেন। বিশেষ করে, সেই কালো দিনগুলোতে হতাহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে সিঁড়ি পর্যন্ত লাশ এবং রোগীদের রক্তে পিচ্ছিল হয়ে যায়। তখন আমাদের টিম যুদ্ধের ময়দানে যেভাবে কাজ করে। আমাদের কেউ রাস্তায় হেঁটে, কেউ এম্বুলেন্সে করে শাহবাগ পার হয়ে ঢাকা মেডিকেলে যাচ্ছে। তাদের পথিমধ্যে পুলিশ আটকাচ্ছে। কাউকে আবার যেতে দেয়নি। তখন মূল রাস্তা বাদ দিয়ে কাকরাইল মোড় হয়ে কেউ মৎস্যভবনের মোড় হয়ে যাচ্ছিলেন। ঢাকা মেডিকেলে আমরা তাৎক্ষণিক পর্যায়ে আমরা ৯টা এম্বুলেন্স ঢাকা মহানগরী থেকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গাতে এম্বুলেন্সের মাধ্যমে সেবা দিতে থাকি। সেসময় যে ওষুধের ক্রাইসিস, ঢাকা মেডিকেলে জরুরী কেয়ার করার জন্য যে ওষুধগুলো পাওয়া যাচ্ছে না; সেগুলো আমরা নিজের টাকা দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সেই ওষুধগুলোর ব্যবস্থা করেছি। আপনি জানেন যে সে সময় দোকানপাট বন্ধ ছিল। তখন দোকানগুলো থেকে অনুরোধ করে খুলে ওষুধগুলো যখন যা লাগতেছিল; আমরা সেখান থেকে সাপ্লাই দিয়েছি। এমনকি রোগীদের ব্যান্ডেজ থেকে শুরু করে পাশাপাশি আশপাশে যে ওষুধের দোকানগুলো ছিল, তারাও সহযোগিতা করেছেন। ফ্রি ওষুধ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ঠিক আছে এই ওষুধটা নিয়ে যান টাকা লাগবে না। এই আপনার গামছার দোকানী গামছা দিয়ে দিয়েছেন। কারণ ব্যান্ডিজ করার মতো কিছ্ইু নেই। অনেককে গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে রক্ত পরা বন্ধ করার চেষ্টা কর হয়েছে। সেই দিনগুলোর পরিস্থিতি স্বচোখে না দেখলে বিশ^াস করানো অসম্ভব। চিকিৎসকরাও দিনরাত পরিশ্রম করে রোগীদের সেবা দিয়েছেন। খেয়ে না খেয়ে কাজ করেছেন। তখন দোকানপাট বন্ধ ছিল। বিশেষ করে কারফিউর সময়গুলোতে। কেউ রাতে ঘর থেকে বের হতে পারবে না। আমাদের কয়েকদিন টানা চলেছে। খাওয়া দাওয়ার কিছু নেই। আমরা ডিম আলু কিনে এনে রেখেছি। দেখা গেছে সিদ্ধ ডিম বা আলু অথবা ডাল দিয়ে খেয়েছি। দেখা গেছে খাওয়ারও কিছু নাই। এভাবেই দেখা গেছে একগ্রুপ যাচ্ছে, আরেকগ্রুপ বিশ্রাম নিচ্ছে। কেউ আবার সারারাত জাগতেছে। এরমধ্যে কয়েকজনের নাম না বললেই নয়। ডা. আলী আফতাব, ডা. আতিয়ার রহমান এবং শাহাদাত হোসেন। আমরা তাদের নির্দেশনা দিচ্ছি, আর তারা কাজগুলো করেছেন। আমরাও তাদের সাথে গিয়েছি। তখন জীবনের ঝুঁকি ছিল। বিশেষ করে তখন রাস্তাঘাটে চলাচল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ডাক্তাররা এম্বুলেন্স দিয়ে যাতায়াতের সময় অনেক স্থানে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। রামপুরাতে এম্বুলেন্স থেকে নেমেছে আর তখনি উপর থেকে এম্বুলেন্সের ওপর বোমা পড়েছে। এস্বলেন্স থেকে নামতে একটু দেরি করলে ওখানেই মারা যেতে পারতো। অনেকে আহত হয়েছে। কিন্তু আমরা আমাদের কাযক্রম শেষ পর্যন্ত চালিয়ে গেছি। একদিন শুক্রবার জুমাআর নামায পরতেছি, এরমধ্যে খবর আসে যে ঢাকা মেডিকেলে এতজন নিহত হয়েছে। যাত্রাবাড়ি এলাকা থেকে সমানে হতাহতরা আসতেছে। বিশেষ করে বিজয়ের দিনে যাত্রাবাড়িতে সবচেয়ে বেশি হতাহত হয়েছে। দেখি আসতেছে লাশের পর লাশ। তাদের অবস্থা আগে যা হয়নি সেদিন তা হয়েছে। সেদিনগুলো যারা না দেখেছে বিশ^াস করতে পারবে না।
দৈনিক সংগ্রাম : সেদিনের দৃশ্যপটটা কেমন ছিল ?
ডা.এম জি ফারুক হোসেন : আমি বলেছিলাম যে যুদ্ধ হয়তো দেখিনি। শুনেছি। সেটা বাস্তবে এখানে দেখেছি। মানুষ কিভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। আহত হয়ে কাতরাচ্ছে। বিশেষ করে চোখে। আমি চোখের ডাক্তার হিসেবে দেখেছি যে, চোখের ৃ কারো সামনের দিকে চলে এসেছে। কারো চোখ খুলে ফেলতে হয়েছে। কারো কারো দুটো চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। কারো কারো কর্ণিয়াতে সমস্যা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার এবং কনসালটেন্স আলা উদ্দিন, তিনি নিরলসভাবে আমাদের চিকিৎসকদের সাথে নিয়ে সারারাত কর্ণিয়াগুলো রিপেয়ার করেছেন। এবং অনেকগুলো মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
দৈনিক সংগ্রাম : চোখের মাধ্যমে আঘাতপ্রাপ্তরা আসলে কিসের মাধ্যমে আঘাতপ্রাপ্ত বলে আপনারা দেখেছেন। জেনেছেন ?
ডা.এম জি ফারুক হোসেন : তখন কোন পিটুনির বিষয় ছিল না। কেবল গুলীর মাধ্যমে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে হাসপাতালে এসেছেন। অনেকের চোখ এক্সরে করে দেখেছি, চোখের ভেতর গুলী। কপালে গুলী আবার অনেকের সারা শরীর ঝাঁজরা।
দৈনিক সংগ্রাম : এগুলো বি রাবার বুলেট নাকি মারণান্ত্র ?
ডা.এম জি ফারুক হোসেন : রাবার বুলেট না। মারণান্ত্র। কারো একটা চোখ শেষ। আবার কারো দুইটা চোখই অন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে আইসিইউতে ছিল। সেখানে থাকা অবস্থায় তাদের চোখ নষ্ট হয়েছে। কারণ আইসিইউ থেকে রোগী নিয়ে যাওয়া আসার সমস্যা। ওটিকে নেওয়া সম্ভব হয়নি। তখন তাদের চোখ কেবল গামছা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। তখন তাদের অনেকের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। পিজিতে এখন পর্যন্ত রোগী আছে। তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এখনো আমরা তাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমরা জীবনবাজি রেখেই কাজ করে যাচ্ছি। এমনকি যেদিন বিজয় আসে; সেদিনও আমরা সকাল বেলা ধারণা করেছিলাম যে, আগের দিন পিজি হাসপাতালে যে নৈরাজ্য চালিয়েছে ফ্যাসিবাদরা। গাড়ি ভেঙে দিয়েছে। লাঠিসোটা নিয়ে আক্রমণ করেছিল। আমরা ধারণা করেছিলাম যে পরের দিন আমাদের সবাইকে গ্রেফতার করা হবে। এব্যাপারে আমরা মাননিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম। মনে করেছিলাম যে আমরা আর কোনদিন হাসপাতালে আসতে পারবো না। কিন্তু আস্তে আস্তে দেখলাম সিনারিউ পরিবর্তন হয়েছে। দেখলাম চারদিক থেকে লোকজন আসলো শাহবাগে। বেলা গড়ানোর সাথে সাথে আর্মি চিফ ঘোষণা দিলো যে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন। তখন জাতির মনে আশা জাগলো যে, নিশ্চয় কিছু একটা ঘটতেছে। আমরা সাথে সাথে ছুটে গেলাম শাহবাগ মোড়ে।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনার অফিস পিজি হাসপাতাল। সেখানকার স্মৃতি যদি বলেন।
ডা.এম জি ফারুক হোসেন : আমাদের সামনে একটা ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো। আমরা সেদিন হাসপাতালের ভেতর আটকা পড়ি। আমরা দেখতেছি যে কেবিন ব্লকের সামনে সেখানে গেটের ভেতরে একজনকে টেনে হ্যাঁচড়ে নিয়ে চিকিৎসকরা লাঠি দিয়ে মেরে স্পটেই মেরে ফেললো। পরবর্তীতে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে আপনারা দেখেছেন যে কিভাবে লাঠি দিয়ে মারছে। সেদিনের ঘটনা ভুলবার নয়। মেরে ফেলার পর কিন্তু লাশ লুকিয়ে রাখা হয়। তাদের কিন্তু কিছুই হয়নি। কিন্তু আমরা যারা স্বচোখে দেখেছি, যেখানে মারা হয়েছে পরে তা ভাইরাল হয়েছে। এটা মিডিয়াতে প্রচার হয়নি অনেকদিন। পরবর্তীতে জানতে পেরেছে মানুষ।
দৈনিক সংগ্রাম : শেখ হাসিনা পালিয়েছে কখন জানতে পারলেন ?
ডা.এম জি ফারুক হোসেন : আমরা শাহবাগেই ছিলাম। সেখানে আমাদের এনডিএফের অফিসে। বলা যায় যুদ্ধকালীন ক্যাম্পের মতে। কন্ট্রোলরুম।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনারা কি পুলিশের কোন বাধার সম্মুখীন হননি ?
ডা.এম জি ফারুক হোসেন : পুলিশের বাধা বলতে আমরা এমন সিক্রেটভাবে ছিলাম যে, আমরা সবাই ডাক্তারের অ্যাপ্রোণ পরে অফিসে ঢুকতাম। সবাই মনে করতো যে, তারা আমাদের কোনভাবেই সন্দেহ করতে পারেনি। বিশেষ করে সেখানে ওষুধের দোকান থাকার কারণে কেউ আমাদের সন্দেহের তালিকায় রাখেনি।
দৈনিক সংগ্রাম : আওয়ামী পন্থী চিকিৎসক বা আপনাদের কলিগরা কোন সমস্যা করেনি ? অসহযোগিতার কোন অভিযোগ আছে কি-না।
ডা.এম জি ফারুক হোসেন : অবশ্যই অসহযোগিতা করেছে। আমাদের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, তখনতো তারাই পরিচালনা করতো। সেখানে বাধা দিয়েছে। ওটিতেও বলা এখানে ভর্তি করা নিষেধ। ওটি করা যাবে না। ইমারজেন্সিতেও বলা হয় এখানে যেন কোন রোগী না আসে। ঢামেকে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাতে অনেককে দেখা গেছে পথিমধ্যেই মারা গেছে। আমার স্বচোখে দেখা যাত্রাবাড়ি থেকে আসা একটা ছেলে, পরবর্তীতে সে ভাল হয়ে গেছে। পরবর্তীতে সে আমাদের কাছে এসে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে। তার পেটে গুলী লেগেছিল। সে বললো আমি যাত্রাবাড়িতে নামায পড়ছিলাম। যোহরের নামাযের পর কি হলো আর খেয়াল নেই। তার পেটে গুলী লেগেছিল। সে আসার পর তাকে কিছুতেই ভর্তি করা হবে না; এরপরও আমরা জোর করে ভর্তি করি। তার ওটি করবে না। কিন্তু আমরা আমাদের যারা চিকিৎসক আছে, নিজেরা গিয়ে অপারেশন করে পেট থেকে গুলী বের করে। রিপেয়ার করে। না হলে কিছুক্ষণ পর ইনফেকশন হয়ে মারা যেত। আবার অরোরা হাসাপাতালে আমাদের ডাক্তার সুজন শরীফ, ডাক্তার মাহফুজ এরা অনেক অপারেশন করেছে। আপনারা জানেন ইবনেসীনাতে অনেক টাকা বিল এসেছে। সেগুলো ফ্রি করে দেওয়া হয়েছে। যদিও তারা এ বিষয়টা প্রচার করতে চায় না। আমাদের পিজিতে পরে আরও অনেক রোগী এসেছে। যেহেতু সেখানে ইমারজেন্সি সেবাটা তেমন নেই। পরবর্তীতে পঙ্গু হয়ে হাত পা হারিয়ে অনেকেই এসেছে। আমরা তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি।
দৈনিক সংগ্রাম : এনডিএফের পক্ষ থেকে কি পরিমাণ রোগেিক সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে তার কোন তালিকা আছে ?
ডা.এম জি ফারুক হোসেন : হ্যাঁ। আন্দোলনের সময়টাতে যা যা প্রয়োজন আমরা সাপোর্ট দিয়েছি। তাদের আর্থিকভাবেও সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে পারসোনালি সহায়তা করা হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে যারা আছে সময় সময় তাদের খোঁজ খবর নেওয়া হয়েছে। পরিবারাকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনারা ডাক্তার মানুষ আপনি জানেন যে, চোখে আঘাতপ্রাপ্ত হলে তাদের পুনর্বাসন করার বিষয়গুলো। চোখে আঘাত প্রাপ্তদে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে আপনার সুপারিশ কি?
ডা.এম জি ফারুক হোসেন : যাদের দুই চোখ চলে গেছে তারাতো শতভাগ প্রতিবন্ধী। তাদের কিছুই করার নাই। সরকারের উচিত আজীবন পুনর্বাসন করা। যাদের এক চোখ আছে তারা কোন রকম চলতেছে। তাদেরও দৃষ্টি শক্তি অনেক কম। তাদের আমরা এদেশেই চিকিৎসা করেছি। যাদের দেশের বাইরে যাওয়ার তাদের বাইরে পাঠানোর সুপারিশ করেছি। তারা সেখানে চিকিৎসা করে এসেছে। অনেকের মাথায় গুলী লেগেছে। তাদের মেমোরি লস হয়েছে। তাদের ব্যাপারে সরকারের দায় রয়েছে। বলা হচ্ছে যাদের জন্য দ্বিতীয় স্বাধীনতা এসেছে, তাদের সার্বিক সহায়তা করা দরকার। পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসা দরকার। তাদের পরিবারেরও দায় দায়িত্ব নেওয়া দরকার।