হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের তিন দিন পার হলেও এখনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত সিএনএফ এজেন্ট ও আমদানিকারকরা। আগুনে কোটি টাকার পণ্য পুড়ে যাওয়ায় ব্যবসায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় দেশের রপ্তানি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে এই ঘটনায় প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বা বারো হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া সিএনএফ এজেন্ট কোম্পানি ইমুট্রান্স বাংলাদেশ লজিস্টিক্স লিমিটেডের ম্যানেজার (আমদানি-রপ্তানি শাখার ইনচার্জ) হাসান জানান, তাদের চারটি ডকুমেন্টসহ প্রায় ১৩ হাজার ডলারের কনসাইনমেন্ট পুড়ে গেছে। এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, খুব তাড়াতাড়ি বিমানবন্দরের ই-গেট খুলে দেওয়া হবে। অন্যদিকে আগুনের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স।
গতকাল সোমবার দুপুরে বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজে লাগা আগুনের ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন ভুক্তভোগীরা। সরেজমিনে দেখা যায়, কার্গো ভিলেজের পুড়ে যাওয়া ভবন থেকে আর ধোঁয়া উঠছে না। ভবনের সামনে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি মোতায়েন রয়েছে এবং কয়েকজন কর্মী ভেতরে কাজ করছেন। পুরো এলাকা পুলিশ ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তায় ঘেরা। কাউকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। আরও দেখা যায়, ভবনের সামনে ফুটপাতে অবস্থান করছেন বিভিন্ন সিএনএফ এজেন্ট ও আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মীরা। গতকালের তুলনায় আজ উপস্থিতি কিছুটা কম হলেও তাদের মুখে হতাশা স্পষ্ট। তারা এখনো ভাবছেন, কীভাবে ক্ষতিপূরণ পাবেন এবং নতুন করে আগত শিপমেন্টগুলো কীভাবে নিরাপদে সরানো যাবে। সিএনএফ এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা শুধু বর্তমান ক্ষতির কথা ভাবছে না, ভবিষ্যতেও এই আগুনের প্রভাব থাকবে। সরকার যদি আর্থিক সহায়তা দেয়, তাহলে হয়ত ব্যবসা স্বাভাবিকভাবে চালাতে পারবেন বলে জানান তারা।
এ বিষয়ে টেলি বাংলাদেশ নামের সিএনএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানের মালিক নাসির উদ্দিন বলেন, ভারত ও চায়না থেকে আমরা গার্মেন্ট শিল্পের জন্য সুতা নিয়ে আসি। আগুনে আমাদের ৪৫টি শিপমেন্ট পুড়ে গেছে, যার বাজারমূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। এর বেশিরভাগই স্যাম্পল ছিল। গার্মেন্ট শিল্পের কাঁচামাল পুড়ে যাওয়ায় রপ্তানিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। কারণ এসব কাঁচামাল দেশের বাজারে বিক্রি করা হয় না-বিভিন্ন পোশাক কারখানা এগুলো দিয়ে তৈরি পোশাক বিদেশে রপ্তানি করে। তিনি আরও বলেন, এই সুতা দিয়ে বিদেশি অর্ডারের সোয়েটার তৈরি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন শিপমেন্টগুলো পুড়ে যাওয়ায় সেই অর্ডার বাতিলের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে শুধু আমদানিকারকই নয়, আমরা সিএনএফ এজেন্ট, এমনকি পোশাক কারখানার কর্মচারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারি সহায়তা দাবি করে তিনি বলেন, আমরা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছি। পাশাপাশি দ্রুত একটি কার্গো ভিলেজের বিকল্প সংরক্ষণাগার তৈরিরও অনুরোধ করেছি, যেখানে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকবে। এখনকার মতো বাইরে মালামাল রাখলে তা বৃষ্টি ও অতিরিক্ত তাপে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যদিকে সিএনএফ এজেন্ট কোম্পানি ইমুট্রান্স বাংলাদেশ লজিস্টিক্স লিমিটেডের ম্যানেজার (আমদানি-রপ্তানি শাখার ইনচার্জ) হাসান জানান, তাদের চারটি ডকুমেন্টসহ প্রায় ১৩ হাজার ডলারের কনসাইনমেন্ট পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, এত বড় শিপমেন্ট হওয়ায় এটি ইনস্যুরেন্স করা ছিল বলে আশা করছি। সাধারণত বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারি ও ইকুইপমেন্ট ইনস্যুরেন্সের আওতায় থাকে। ইনস্যুরেন্স থাকলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইনের অধীনে কোম্পানি ক্ষতিপূরণ বহন করবে। তবে এখনো বায়ারদের কাছ থেকে ক্লেইম বা প্রতিক্রিয়া পাইনি। আমরা চাই সরকার আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। না হলে আমরা স্বাভাবিকভাবে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবো না। কারণ এই আগুনের দীর্ঘ মেয়াদি একটা প্রভাব পড়বে একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ওপর।
কার্গো ভিলেজের আমদানি অংশে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সরবরাহ শৃঙ্খলে বড় ধাক্কা লেগেছে। এর ফলে আসন্ন বড়দিনের বিক্রির মৌসুমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি চালান ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, আমদানি করা নমুনা ও উৎপাদনের উপকরণগুলো আগুনে পুড়ে যাওয়ায় বর্তমান ও ভবিষ্যতের উৎপাদন কাজ থেমে যেতে পারে। এতে পণ্য ডেলিভারিতে দেরি হতে পারে এবং অনেক অর্ডারও বাতিল হওয়ার ঝুঁকি আছে। শিল্পসংশ্লিষ্টদের ধারণা, শাহজালাল বিমানবন্দরে পুড়ে যাওয়া মালামালের ক্ষতির হিসাব প্রাথমিকভাবে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। ঢাকার এই বিমানবন্দরের আগুন ছিল গত এক সপ্তাহে তৃতীয় বড় দুর্ঘটনা, যা ব্যবসায়ীদের বেশ দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে বাড়তি শুল্ক, ঋণের সুদ বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও দেশীয় বাজারে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া—সব মিলিয়ে বাণিজ্য খাত সংকটে আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পণ্যের ওপর নতুন করে আরোপিত ২০ শতাংশ শুল্ক। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার।
বিমানবন্দরে এই আগুন শুধু দেশের সুনামকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও সুবিধা করে দেবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই ক্ষতিকে শুধু পুড়ে যাওয়া পণ্যের আর্থিক মূল্য দিয়ে বিচার করা যাবে না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পুরো রপ্তানিমুখী পোশাক ও ওষুধ শিল্পে, এমনকি স্থানীয় বাজারনির্ভর ব্যবসাগুলোতেও। আমদানি কার্গো অঞ্চলে পোশাকের লেইস বা আনুষঙ্গিক সামগ্রী থেকে শুরু করে স্পেয়ার পার্টস, নতুন অর্ডারের নমুনা— সবকিছুই সংরক্ষিত ছিল। পোশাক কারখানাগুলো সময়মতো পণ্য পাঠাতে বিমান পরিবহনের ওপর নির্ভর করে। ফলে আগুনের প্রভাব তাদের জন্য আরও জটিল ও গুরুতর হয়ে উঠল।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএফএফএ) সাবেক সহসভাপতি নুরুল আমিন সতর্ক করেন, ‘আগুনের কারণে বিপুল পণ্য আটকে যাওয়ায় এ বছর বিমান পরিবহনের চাপ আরও বেড়ে যাবে।’ তিনি জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে ধর্মঘটের কারণে আগেই অনেক পণ্য শাহজালাল বিমানবন্দরে স্থানান্তর করা হয়েছিল।
সাধারণত প্রতিদিন বিমানবন্দরে এক হাজার টন পর্যন্ত শুকনো পণ্যের ব্যবস্থা করা হয়। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রপ্তানির মৌসুমে এই পরিমাণটা আরও বেড়ে যায়। এখন পুড়ে যাওয়া উপকরণ দ্রুত প্রতিস্থাপন করতে হবে, যা আবারও শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো চাপ বাড়াবে। শিল্পখাতের নেতারাও দ্রুত সমাধান খুঁজছেন। বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) পরিচালক ফয়সাল সামাদ জানান, কার্গো অতিরিক্ত হওয়ার কারণে এবং দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে সরকার সাময়িকভাবে বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে গুদামের জায়গা বরাদ্দ করেছে। বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি ইনামুল হক খান জানান, বাণিজ্য উপদেষ্টা এস কে বশির উদ্দিনের কাছ থেকে সরকারিভাবে সহায়তার আশ্বাস পাওয়া গেছে। সংগঠনটি সদস্যদের ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ করছে।
যা বলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা: খুব তাড়াতাড়ি আগামী দু-চার দিনের মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ই-গেট খুলে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে উপদেষ্টা এ কথা জানান। তিনি বলেন, আমরা খুবই তাড়াতাড়ি বিমানবন্দরে এই গেট খুলে দেবো। পাসপোর্ট দেখিয়েই যেন যাত্রীরা ঢুকে যেতে পারেন। আর আমরা বলে দিয়েছি ই-পাসপোর্ট বা ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট এই ডিসেম্বরের মধ্যে মোটামুটি বিদেশেরগুলো করে দেবো। বিমানবন্দরের ই-গেট কবে নাগাদ খুলে দেওয়া হবে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, ই-গেট ইনস্টল হয়ে গেছে, হয়তো দু-চার দিনের মধ্যেই আমরা খুলে দেবো।
ফায়ার সার্ভিসের তদন্তকমিটি: ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্তকমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। কমিটিকে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে। সদস্য করা হয়েছে- ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা জোন ৩ এর উপসহকারী পরিচালক মো. আব্দুল মান্নান, কুর্মিটোলা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. নাহিদ মামুন ও ফায়ার সার্ভিস ঢাকা ১৯ এর ওয়্যারহাউজের ইন্সপেক্টর মো. তোজাম্মেল হোসেন। সদস্য সচিব করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন। গত ১৮ অক্টোবর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনের ঘটনায় সাত সদস্যের একটি তদন্তকমিটি গঠন করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। কমিটিকে আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটিতে বিমানের ফ্লাইট সেফটি শাখার প্রধানকে সভাপতি এবং ইনস্যুরেন্স শাখার উপব্যবস্থাপককে সদস্যসচিব করা হয়েছে। এ ছাড়া বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, করপোরেট সেফটি অ্যান্ড কোয়ালিটি শাখার মহাব্যবস্থাপক, কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স শাখার প্রধান প্রকৌশলী, নিরাপত্তা শাখার উপমহাব্যবস্থাপক, কার্গো রপ্তানি শাখার উপ-মহাব্যবস্থাপককে তদন্ত কমিটির সদস্য করা হয়েছে। গত ১৯ অক্টোবর কার্গো ভিলেজে অগ্নিকা- তদন্তে স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনির নেতৃত্বে ৭ সদস্যের কোর কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি আগামী ৫ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।