বিশ্ব নগর পরিকল্পনা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই নগর এবং জনবসতি গড়তে সারা দেশের পরিকল্পনার কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদনকৃত স্থানিক পরিকল্পনা অধ্যাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মত দেন তারা। গতকাল শুক্রবার সকালে বিআইপি কনফারেন্স হলে অনুষ্ঠিত সেমিনারে তারা একথা বলেন।
বিআইপির সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান। তিনি বলেন, এসডিজি ১১ বাস্তবায়নের জন্য তাৎক্ষণিক ও অগ্রাধিকারমূলক কর্মপরিকল্পনাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে যে কাজগুলো সম্পন্ন করা সম্ভব এবং ২০৩০ সালের মধ্যে যা বাস্তবায়নযোগ্য, তার জন্য একটি সুস্পষ্ট অগ্রযাত্রা নির্ধারণ করে তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, এসডিজি ১১ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা এসডিজি ১ ও ২-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। তাই এসডিজি ১১-এর পাশাপাশি এই দুটি লক্ষ্যও সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের এসডিজি ১১ অর্জনের গতি ধীর হলেও সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে তা সম্ভবপর। বিশেষ করে আবাসন উন্নয়ন, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী চলাচল, নিয়ন্ত্রিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বায়ু মান উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনা ও অংশগ্রহণমূলক বাস্তবায়নের মাধ্যমে সীমিত সম্পদকেও দৃশ্যমান উন্নয়নে রূপান্তর করা সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়-এর সচিব মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (ঝউএ)-এর মূল উদ্দেশ্যই হলো দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সকল শ্রেণির মানুষের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যস্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করা। ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ)-এ যেসব এলাকা কৃষিজমি ও জলাধার হিসেবে নির্ধারিত ছিল, আজ তার অনেকটুকুই দখল দূষণে হারিয়ে গেছে, যা পরিকল্পিত নগরায়নের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। তিনি আরও বলেন, ঢাকার ভেতরে আমরা কত মানুষকে আবাসনের সুযোগ দিতে পারব এবং কীভাবে নতুন জনসংখ্যার অতিরিক্ত চাপ ঢাকায় আসা রোধ করা যায়, সে বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রমাণভিত্তিক পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি। এই গবেষণা ও পরিকল্পনাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর প্রেসিডেন্ট পরিকল্পনাবিদ প্রফেসর ড. আদিল মুহম্মদ খান বলেন, বিগত বছরগুলোতে আমরা পরিকল্পনা ও উন্নয়নে জনগণের প্রকৃত চাহিদাগুলো প্রতিফলিত করতে পারিনি। বরং অনেক সময় দেখেছি, ইচ্ছাকৃতভাবে এমন অনেক প্রকল্প নেয়া, যা সমাজের নির্দিষ্ট পক্ষের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এর ফলে ঘটেছে পরিবেশ দূষণ, সম্পদের অপচয় এবং দুর্নীতি। বর্তমানে আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, যেখান থেকে আমাদের পরিকল্পনা প্রক্রিয়াকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশন, সাধারন অর্থনীতি বিভাগ এর সদস্য সচিব ড. মঞ্জুর হোসেন বলেন, এসডিজি ১১-এর সঙ্গে এসডিজি ১৬ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গত দুই দশকে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়েছে, সেগুলোকে যথাযথভাবে উন্নয়ন করা হয়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী না হলে কোনোভাবেই এসডিজির লক্ষ্যসমূহে অগ্রগতি অর্জন সম্ভব নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর-এর পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোঃ মাহমুদ আলী বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশ টেকসই নগরায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হসছে বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০, ১০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র, জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা ২০২৫। তিনি জানান, নগর এলাকার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বস্তিতে বসবাস করছে, যেখানে নিরাপদ আবাসন, স্বাস্থ্য বাবস্থা অত্যন্ত খারাপ। এছাড়াও নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর ২০৩০ সালের মধ্যে জাতীয় স্থানিক পরিকল্পনা প্রণয়ন-এর উদ্যোগ নিয়েছে, যা সারা দেশের পরিকল্পিত উন্নয়ন এর মূল ভিত্তি হবে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বর্তমান চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো: রিয়াজুল ইসলাম বলেন, নানান সীমাবদ্ধতা ও চাপের মধ্যেও পরিকল্পিত ঢাকা মহানগরী গড়তে রাজউক কাজ করে যাচ্ছে।
জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ এর চেয়ারম্যান মোসা: ফেরদৌসী বেগম বলেন, আগামী প্রজন্মকে একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য শহর উপহার দিতে হলে শহর পরিকল্পনা অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। তিনি আরও বলেন, আজকের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের মাধ্যমে আমরা সবাই ধারণা পেয়েছি যে, এসডিজি ১১ কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে এবং কতটুকু এখনও বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। এক্ষেত্রে সকল পেশাজীবী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান মিলে কাজ করলে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
বিআইপির যুগ্ম সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ তামজিদুল ইসলাম স্বাগত বক্তব্যে বলেন, এসডিজি ১১ বাস্তবায়নে অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই ও স্থিতিস্থাপক নগর পরিকল্পনা অপরিহার্য। অনুষ্ঠানে বিআইপির নেতৃবৃন্দ ছাড়াও পরিকল্পনাবিদসহ নাগরিক ও পেশাজীবীগণ বক্তব্য রাখেন।