নাছির উদ্দিন শোয়েব: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। তবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। এমনকি দায়িত্ব পালনে ও সক্রিয় হয়নি পুলিশ। নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ক্রমে সক্রিয় হচ্ছে। তারা গোপনে-প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে নিষিদ্ধ দলের নেতা-কর্মীরা জমায়েত হয়ে গোপনে বৈঠক করছে। অনেক ক্ষেত্রেই তা নজরে আসছে না, বা নজরে রাখছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের কার্যক্রম গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখার নির্দেশনা থাকলেও সেক্ষেত্রে অনেকটাই ঢিলেঢালা পুলিশ। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল করছে নিষিদ্ধ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। কোথাও কোথাও পুলিশের উপস্থিতিতেই মিছিল হচ্ছে। এসব মিছিল থেকে ককটেল বিস্ফোরণ ও হামলার মত ঘটনাও ঘটছে। মাঝে মাঝে ঝটিকা মিছিল থেকে গ্রেফতার হলেও অনেক স্থানে সংগঠনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এরআগে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম ও ঝটিকা মিছিলের বিরুদ্ধে পুলিশের কোনো নিষ্ক্রিয়তা পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.)। যেখানে নিষিদ্ধ দলের মিছিল হবে ঠেকাতে না পারলে দায়িত্বরত পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশ সদরদফতর থেকেও মাঠ পর্যায়ের পুলিশকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জিরোটলারেন্স নীতিতে আগানোর কথাও বলা হয়। এছাড়া অবৈধ অস্ত্র, মাদক এবং চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মাঠ পর্যায়ে দেওয়া হয়েছে বিশেষ বার্তা। অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণার কথাও বলছে সরকারের শীর্ষ মহল। কিন্তু শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশনার পরও মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সে নির্দেশনা যথাযথ ভাবে মানছে না।
পুলিশ সদরদফতর সূত্রে জানা গেছে, এ অবস্থায় পুলিশকে সক্রিয় হতে আরও কঠোর হচ্ছে প্রশাসন। এমনকি নিষিদ্ধ সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধে সক্রিয় না হলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এদিকে গত শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের ঝটিকা মিছিল ঠেকাতে মাঠে দায়িত্ব পালন না করে খাওয়া ও বিশ্রামে থাকার অভিযোগে তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়। তারা হলেন-মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) মেহেদী হাসান, পরিদর্শক (অপারেশন) আব্দুল আলীম ও ডিউটি অফিসার এসআই মাসুদুর রহমান। এদিন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপারেশন) এস এন নজরুল ইসলাম মোহাম্মদপুর থানা পরিদর্শনে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন। পরে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী স্বাক্ষরিত আদেশে তাকে কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ডিএমপি সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সহকারি কমিশনার মেহেদী হাসানকে ডিএমপি সদর দপ্তরে এবং পরিদর্শক আব্দুল আলীম ও এস আই মাসুদ লাইন ওয়্যারে সংযুক্ত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত শুক্রবার শহরজুড়ে আওয়ামী লীগের কর্মসূচির বিষয়ে পুলিশের কাছে আগাম তথ্য ছিল। দায়িত্বশীল সবাইকে মাঠে থেকে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে কিনা তা তদারকিতে মাঠে নামানো হয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে মোহাম্মদপুর থানায় যান অতিরিক্ত কমিশনার (অপারেশন) এস এন নজরুল ইসলাম। গিয়ে দেখতে পান থানার ৪ থেকে ৫টি গাড়ি থানার ভেতরে ও সামনে রাখা আছে। ভেতরে গিয়ে ডিউটি অফিসারকে তার সিটে পাননি। তিনি খেতে গিয়েছিলেন বলে পরে জানা গেছে। একইভাবে পরিদর্শক অপারেশন ও সহকারী কমিশনার দুজনই দুপুরের খাবার এবং বিশ্রামের জন্য থানায় অবস্থান করছিলেন। অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম বলেন, সবাইকে মাঠে থেকে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। খাওয়া, নামাজের জন্য সবার একসঙ্গে যাওয়া যাবে না। সবাই একসঙ্গে চলে আসলে মাঠে কারা দায়িত্ব পালন করবে? তারা সুস্পষ্টভাবে সিনিয়রদের কমান্ড ফলো করেননি। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
ইতোমধ্যে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যারা নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর ঝটিকা মিছিল-সমাবেশ থামাতে পারবে না, তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও কয়েকজন ওসিসহ বেশ কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এতে করে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন পুলিশ সদস্য জানান, হঠাৎ করে কয়েকজন মিলে ব্যাগ থেকে ব্যানার বের করে দু-তিন মিনিটের একটি মিছিল করে স্লোগান দেয়। আর এটার ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেয়। ফলে আগাম তথ্য না থাকলে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন ঝটিকা মিছিল করছে। হঠাৎ করে কয়েক ডজন বা কয়েকশত নেতাকর্মী কোনও এলাকায় উপস্থিত হয়ে স্বল্প সময়ে মিছিল বের করে স্লোগান দিয়ে দ্রুত সটকে পড়েন। কোনও কোনও মিছিল থেকে ককটেল-বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। বেশ কিছু জায়গায় অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে।
এ অবস্থায় এসব মিছিল ঠেকাতে মাঠ পর্যায়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। ডিএমপির ৫০টির থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেছেন, যে থানা এলাকায় ঝটিকা মিছিল হবে, সেই থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) থেকে শুরু করে পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তারা জবাবদিহির আওতায় আসবেন। দায়িত্বে গাফিলতি প্রমাণ হলে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, দায়িত্বে অবহেলা বা শিথিলতার কারণে আর কেউ ছাড় পাবেন না।
গত বছরের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ধাক্কা এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি পুলিশ। সংস্থাটিকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করা হলেও এখনো বাহিনীটির বড় অংশের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ রয়েছে। এই সুযোগে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। বেশির ভাগ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা পুলিশের সাহায্য চেয়েও পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করছেন। পুলিশ কখনো কখনো দর্শকের ভূমিকা পালন করছে এমন অভিযোগও আছে। ফলে চোখের সামনে ঘটছে হত্যা ও খুনোখুনির মতো ঘটনা। বিশেষ করে গত ছয় মাসে এমন কিছু হত্যার ঘটনা ঘটেছে, যার আগে পুলিশ পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ থাকলেও নেয়নি। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষনা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন থেকে সক্রিয় না হলে নির্বাচনে সহিংসতা ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে বলে সরকারের সর্বোচ্চ মহলও চিন্তিত। তাই পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে সক্রিয় করার জন্য সরকার এখন থেকেই শক্ত হচ্ছে। বিশেষ করে দায়িত্ব পালনে মাঠে সব চেয়ে বেশি সক্রিয় থাকতে হয় পুলিশকে। তাই পুলিশের চেইন অব কামন্ড যাতে ভেঙে না পড়ে সে জন্য নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে বিভাগীয়সহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।