সীমান্তে হত্যাকান্ড বন্ধ, দেখামাত্র গুলি করা এবং দুই দেশের নাগরিকদের নিরাাপত্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিজিবি ও বিএসএফ এর উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের একদিনের মাথায়ই এক বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ। গত ২৮ আগস্ট দুই দেশের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্তহত্যা শূণ্যের কোটায় নামিয়ে আনার যে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল বিএসএফ তা ভঙ্গ করে চারদিন ব্যাপি বৈঠক শেষ হওযার পর দিনই। বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৬তম সম্মেলনে সীমান্তে আক্রমণ, নির্যাতন ও হামলার ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনাসহ ১০ বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হয়েছিল।
যদিও পিলখানায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএসএফ মহাপরিচালক সীমান্তে গুলি করার স্বপক্ষে অনেক বিভ্রান্তমূলক তথ্য দেয়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ সদস্যদের প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার ও গুলি করে হত্যা প্রসঙ্গে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ মহাপরিচালক দালজিৎ সিং চৌধুরীর এসব বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। কিন্তু বৈঠক শেষে নিজ দেশে ফেরার পরই বিএসএফ মারমুখি হয়ে ওঠে।
সর্বশেষ সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার ডোনা সীমান্তে ভারতের অভ্যন্তরে বিএসএফ এর গুলিতে নিহত আব্দুর রহমানের লাশ তিনদিন পর হস্তান্তর করা হয়েছে। সোমবার রাত ১টার দিকে ডোনা সীমান্তের বাঙালিপাড়া এলাকায় বিজিবি-বিএসএফের পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে লাশ হস্তান্তর করা হয়। কানাইঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল আউয়াল বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে জানাজা শেষে লাশ দাফন সম্পন্ন করা হয়। গত শুক্রবার জুমার নামাজের পরে ডোনা সীমান্তে ভারতের অভ্যন্তরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান যুবক আব্দুর রহমান। কানাইঘাট উপজেলার ডোনা সীমান্তবর্তী বড় চাতল পূর্ব গ্রামের মৃত খলিলুর রহমানের ছেলে তিনি। ঘটনার পর নিহতের পরিবার ও স্থানীয়রা জানান, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের গুলিতে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আরও চারজন আহত হয়েছেন।
জানা গেছে, গত ১১ মাসে অন্তত ৩৪ জন বাংলাদেশিকে গুলি ও নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী আগের বছরগুলোতেও সীমান্ত হত্যার ঘটনা গটেছে। তবে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৩১ ও ৩০ জন ছিল। বারবার আশ্বাসের পরও এই হত্যাকাণ্ড থামেনি। এদিকে ভারত চলতি বছর ৭ই মে থেকে এখন পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি মানুষকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। যার মধ্যে রোহিঙ্গা ও ভারতীয় নাগরিকও রয়েছে। সীমান্তে বিস্ফোরণ, ড্রোন উড়ানো ও গুলি ছোঁড়ার ঘটনাও ঘটছে। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাঝে বিএসএফ প্রায় প্রতি মাসেই বাংলাদেশিদের হত্যা করেছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বিএসএফ-এর হাতে ১৫ জন নিহত ও ২৯ জন আহত হয়েছেন। আসকের আরেক প্রতিবদেন বলা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন ১৩ বাংলাদেশি নাগরিক। আহত হয়েছেন আরও ১১ জন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি-জুন মাসে সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন ১০ জন, আহত ১৪ জন। অন্যদিকে মিয়ানমার সীমান্তে মর্টার শেলের আঘাতে ১ জন বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ১ জন নিহত হন।
জানা যায়, ৫ আগস্টের পর অনুপ্রবেশের ঘটনা কমে গেলেও বিএসএফ-এর কর্মকাণ্ডে সীমান্তে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। এখন পর্যন্ত বিজিবি কোনো ভারতীয় নাগরিকককে দেখামাত্র গুলি ছোড়েনি। তারপরও বিনা উসকানিতে বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিকরা বাংলাদেশিদের টার্গেট করে হত্যা ও অপহরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, দু’টি দেশের সীমান্তে এভাবে দেখামাত্র গুলি করে হত্যার মতো ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোনো সীমান্তে ঘটেনি। বিএসএফ যেভাবে গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যা করছে এর বিপরীতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) যদি এমন ঘটনা ঘটাতো তা হলে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো। বিজিবির সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা সীমান্তে কোনো ভারতীয়কে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েনি। অবৈধভাবে কয়েকজনন বিএসএফ সদস্য বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে ঢুকে পড়লেও তাদেরকে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ফেরত পাঠানো হয়। বাংলাদেশ সহনশীল আচারণ করলেও সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে হত্যাকাণ্ড থামছেই না। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার চিত্র যেন এক অমীমাংসিত প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একের পর এক বৈঠক, আলোচনা, প্রতিশ্রুতি কিছুতেই কাজে আসছে না। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে না বলে এলেও তাদের কথার সঙ্গে কাজের মিল নেই। বরং সীমান্তে ৯৫ শতাংশ মৃত্যুই হচ্ছে বিএসএফ-এর গুলিতে। সীমান্ত হত্যার এমন চিত্র শুধু দুই দেশের সম্পর্ককেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও নৈতিকতার ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারত শুধু সম্মতই হয়, সহিংসতা থামেনি। বিএসএফ বন্ধ করেনি মারণাস্ত্রের ব্যবহার। তারা বলছেন, সীমান্তে চোরাচালান রোধ যেমন জরুরি, তেমনই মানবাধিকারও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিচারবহির্ভূত হত্যা কোনো সভ্যদেশের কাম্য হতে পারে না। সীমান্তে হত্যা শূন্যে আনতে হলে ভারতকে আন্তর্জাতিক চাপে রাখতে হবে। বিএসএফ-এর গুলি, নির্যাতনের ঘটনা সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়াচ্ছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের সঙ্গে চীন, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সীমান্ত থাকলেও গত ১০ বছরে এসব সীমান্তে কোনো বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি, কুড়িগ্রাম সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানীর লাশ নাড়িয়ে দিয়েছিলো বিশ্ব বিবেক। তবে বিবেক নড়েনি ভারতের। তোয়াক্কা করেনি কোন নিয়ম-কানুন-আইনের। বন্ধ হয়নি বাংলাদেশি হত্যা। ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত যেন নির্মমতার প্রতীক।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, এটি নিঃসন্দেহে আইন-বহির্ভূত হত্যা। কারণ যারা নিহত হয়েছেন, তাদের কারও হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না, তারা কোনো অস্ত্র ব্যবহারও করেননি। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধে একটি স্বাধীন সিভিল কমিশন গঠন করা জরুরি। সরকারি কমিশন হলে সেটি কার্যকর হবে না। ভারতের সঙ্গে সরাসরি ৫টি দেশের সীমানা থাকলেও, অন্য দেশের সীমান্তে বাংলাদেশের মতো হত্যার ঘটনা ঘটে না। চীনের সঙ্গে নির্দিষ্ট সীমানায় নিরস্ত্র পাহারার চুক্তি আছে ভারতের। বাংলাদেশও প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার না করার প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে সে প্রস্তাবের অগ্রগতি হয়নি। বর্ডারে হত্যায় সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘন হলেও বিচার হয়নি। এসব বিষয়ে ভারত একতরফা আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখালে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার কথা বলছেন আইনজীবীরা।