* ২০০টির বেশি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ১০০টিরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে ৩৩০টিরও বেশি মারণাস্ত্র হামলা

* দুই শীর্ষ সেনা কর্মকর্তা ও ৬ পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত

ইরানজুড়ে গতকাল শুক্রবার ভোরে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে পাঁচটি ধাপে শতাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। ইরান হামলার মধ্যদিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে বড় যুদ্ধের সূচনা করল ইসরাইল। ইরান ও ইসরাইলের মাঝে পাল্টাপাল্টি হামলা দেখা গেলেও ইরানের মাটিতে এমন সরাসরি সামরিক অভিযান ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর এবারই প্রথম। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাসহ দেশটির বিভিন্ন স্থানে ইসরাইলের প্রাণঘাতী এসব হামলার কঠোর জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে তেহরান। ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ চান ইরানিরাও, কুম শহরসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ করেছে ইরানের জনগণ। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ভেস্তে দিতে ইসরাইল ইরানে হামলা চালিয়েছে, তাতে ইরানের একাধিক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, ২০০টির বেশি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে ১০০টিরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে ৩৩০টিরও বেশি মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। হামলার পর কয়েক ঘণ্টায় ইরান থেকে ইসরাইলের দিকে ১০০টিরও বেশি ড্রোন ছোড়া হয়েছে। ইসরাইল প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডেফরিন এমনটি জানিয়েছেন। হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) প্রধান কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি ছাড়াও ২৫ বছর ধরে দেশটির আণবিক শক্তি সংস্থার প্রধানের দায়িত্বে থাকা ফারেদুন আব্বাসি নিহত হয়েছেন। এছাড়াও নিহতদের মধ্যে রয়েছেন-ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, খাতাম আল-আনবিয়া সেন্ট্রাল হেডকোয়ার্টারের কমান্ডার ঘোলামালি রশীদ। আরও রয়েছেন, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত পরমাণু বিজ্ঞানী মোহাম্মদ মাহদি তেহরানচি, আব্দুলহামিদ মিনুচেহর, আহমদ রেজা জোলফাকারি, সৈয়দ আমির হোসেন ফেকহি, মাতলাবিজাদেহ। এবং ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির শীর্ষ উপদেষ্টা আলি শামখানিও গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন বলে দেশটির গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে। তেহরানে একাধিক ইসরাইলি হামলার পর ইরান সরকারিভাবে তাদের আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করেছে। ইরানে ইসরাইলী হামলার এই সময়টিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মাত্র দুইদিন বাদেই আগামী রোববার ওমানের মাস্কটে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ দফা আলোচনা হওয়ার কথা ছিলো। ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ইসরাইলের বড় ধরনের বিমান হামলার পর বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এই অভিযানে ইরান দাবি করেছে, তাদের একাধিক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। পাশাপাশি আবাসিক এলাকায়ও হামলা চালানো হয়েছে, যাতে আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন, এদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। খবর টাইমস অব ইসরাইল, আল জাজিরা, এএফপি, বিবিসি, রয়টার্স।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এই হামলার তীব্র নিন্দা করে বলেছেন, এটি ইসরাইলের বর্বর স্বভাবের প্রমাণ। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, এই হামলা ইসরাইলের জন্য করুণ পরিণতির পথ তৈরী করেছে এবং এর ফলাফল তারা অবশ্যই ভোগ করবে।

এদিকে ইরানের বেশ কয়েকটি শহরে হামলা করে এবার পাল্টা হামলা ভয় ও আতঙ্কে নিজ দেশের চারপাশে সেনা মোতায়েনে ব্যস্ত ইসরাইল। ইরানে হামলার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইসরাইল বিশ্বব্যাপী তার সব কূটনৈতিক মিশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইরানের সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, তেহরানজুড়ে ৬ থেকে ৯টি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। হামলা হয়েছে আবাসিক ভবনেও। ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের মুখপাত্র আবুলফজল শেখারচি বলেন, জায়নবাদী এই হামলার জবাব অবশ্যই ইরানি সশস্ত্র বাহিনী দেবে। মুখপাত্র আরও বলেন, ইসরাইলকে তার হামলার চড়া মূল্য দিতে হবে এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর কঠোর জবাবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এছাড়াও এই হামলার প্রভাব পড়েছে প্রতিবেশী দেশ ইরাকেও। কাতার এয়ারপোর্টের ফ্লাইট ইনফরমেশন বোর্ডে দেখা যাচ্ছে, ইরানের পাশাপাশি ইরাকগামী ফ্লাইটগুলো একের পর এক বাতিল হচ্ছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে বিভিন্ন এয়ারলাইনস ইরাকের আকাশপথও এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে। এদিকে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, ইসরাইলের হামলার জবাব হবে কঠোর ও ফলাফল নির্ণায়ক। হামলা কি অত্যাসন্ন জানতে চাইলে একই সূত্র বলেছে, ইরানের প্রতিশোধ কেমন হবে, তার বিস্তারিত নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা চলছে।

যেসব স্থানে হামলার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সেসব হলো রাজধানী তেহরান ও এর আশপাশের সামরিক স্থাপনা; তেহরানের দক্ষিণে নাতানজ শহর, যেখানে ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র অবস্থিত; তেহরানের উত্তর-পশ্চিমে তাবরিজ শহর, যেখানে একটি পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র ও দুটি সামরিক ঘাঁটির কাছে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে; তেহরানের দক্ষিণে ইস্পাহান শহর; তেহরানের দক্ষিণ-পশ্চিমে আরাক শহর ও পশ্চিমে কেরমানশাহ শহর।

ইসরাইল ও ইরানের সামরিক কর্মকর্তা বলেন, শত শত হামলা চালানো হয়েছে এবং অন্তত আটটি স্থানে (শহরে) লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে পাওয়া বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলী সামরিক বাহিনী ইরানের ছয়টি স্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে। আর ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, গত কয়েক ঘণ্টায় অন্তত দুটি ধাপে হামলা চালানো হয়। তবে নিশ্চিত না হলেও এখন তৃতীয় দফার হামলা চলমান থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, তেহরান থেকে প্রায় ২২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে নাতানজ শহরে অবস্থিত ইরানের প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে তাঁর দেশ। ইরানের যেসব বিজ্ঞানী দেশটির জন্য (পারমাণবিক) বোমা তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হয়। ইরানি বোমা তৈরির সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীদেরও আমরা নিশানায় রেখেছি। তিনি আরও বলেন, যত দিন প্রয়োজন, তত দিন এমন হামলা চলবে।

ভয় ও আতঙ্কে চতুর্দিকে সেনা মোতায়েন ইসরাইলের: ইরানের বেশ কয়েকটি শহরে হামলা করে এবার পাল্টা হামলা ভয় ও আতঙ্কে নিজ দেশের চারপাশে সেনা মোতায়েনে ব্যস্ত ইসরাইল। তেহরানে হামলার জবাবে ইরানও ইসরাইলে পাল্টা হামলা চালাতে পারে এমন শঙ্কা থেকে জেরুজালেমের সুপারশপগুলোয় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে খাদ্য ও পানি। মজুত করার জন্য মানুষ এখন এগুলো হুমড়ি খেয়ে কিনছে। একই কারণে তেল আবিবের রাস্তাঘাটও ফাঁকা হয়ে গেছে। গত দবুধবার রাত ৩টার দিকে সাইরেনের শব্দ ও মোবাইলের সতর্কবার্তায় ঘুম ভাঙে ইসরাইলের জনগণের। দেশটির সরকারের তরফ থেকে মানুষকে জানানো হয়, তাদের সামনে একটি ‘গুরুতর হুমকি’ রয়েছে। সবাই যেন আশ্রয়কেন্দ্রের কাছাকাছি স্থানে অবস্থান করে।

দেশটির সেনাপ্রধান আইয়াল জামির টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে বলেছেন, তার সেনাবাহিনী ১০ হাজারের বেশি সেনা মোতায়েন করছে এবং সব সীমান্তজুড়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সতর্ক করে তিনি বলেন, যে কেউ আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে চাইবে, তাকে বড় মূল্য দিতে হবে।

আইয়াল জামির আরও বলেন, ইসরাইলের জনগণকে আমি সম্পূর্ণ সাফল্যের নিশ্চয়তা দিতে পারি না। ইরানি শাসকগোষ্ঠী প্রতিশোধ নিতে আমাদের ওপর হামলার চেষ্টা করবে। এ হামলার সম্ভাব্য মূল্য আমাদের আগের অভিজ্ঞতা থেকে আলাদা হবে। আমরা এ অভিযানের প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই নিচ্ছি। বাস্তব ও তাৎক্ষণিক হুমকির বিরুদ্ধে প্রস্তুতির জন্য সেনাবাহিনীর সব শাখা ও বিভাগ মিলিয়ে নজিরবিহীন চেষ্টা চালানো হয়েছে, বলেন জামির।

বিশ্বজুড়ে দূতাবাস বন্ধ করছে ইসরাইল: ইরানে হামলার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইসরাইল বিশ্বব্যাপী তার সব কূটনৈতিক মিশন বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে অবস্থিত ইসরাইলী দূতাবাস এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক পরিস্থিতির কারণে ইসরাইল তার বৈদেশিক মিশনগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ করছে এবং কনস্যুলার সেবাও আপাতত প্রদান করা হবে না। তবে দূতাবাসগুলো কতদিন বন্ধ থাকবে সে বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানির একজন উপদেষ্টা বলেন, ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ইরাক সরকার টানা আলোচনা চালাচ্ছে, যাতে ইরানের ওপর হামলা হলে ঐ গোষ্ঠীগুলো কোনো পাল্টা প্রতিক্রিয়া না দেখায় । কারণ, ইরাক কোনো নতুন যুদ্ধে জড়াতে চায় না। ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর আরেকজন ফরেন পলিসি বিষয়ক উপদেষ্টা এর আগে সতর্ক করে বলেছিলেন– ইরানে যদি এবার কিছু ঘটে, তাহলে তা এমন কিছু হবে যা আমরা আগে দেখিনি।

ইরানের ড্রোনের ঝাঁক ছুটছে ইসরাইলের দিকে: ড্রোনগুলো ভূপাতিত করতে কাজ করছে ইসরাইলী প্রতিরক্ষা বাহিনী। ইরান থেকে ছোড়া ড্রোনগুলো ইসরাইলে পৌঁছাতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে। এর আগে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায় ইসরাইল। এই হামলায় দেশটির রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধানসহ শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার প্রাণ গেছে। ডেফরিন জানান, ইসরাইলি বিমানবাহিনীর দুই শতাধিক যুদ্ধবিমান ইরানের শতাধিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এতে ব্যবহৃত হয়েছে প্রায় ৩৩০টি বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র। তবে ইরানি ড্রোনগুলো কখন ইসরাইলে পৌঁছাবে, সে বিষয়ে কিছু জানাননি তিনি। এর আগের হামলায় এমন ড্রোন ইসরাইল পর্যন্ত পৌঁছাতে কয়েক ঘণ্টা সময় নিয়েছিল। এর আগে ইরানের আরেকটি হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ বেশ কয়েকটি দেশ ইসরাইলের পাশে ছিল। তবে এবার আগাম হামলা করেছে ইসরাইল। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে আগের মতো সহায়তা তারা পাচ্ছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

অন্যদিকে ইরানে ইসরাইলী হামলার পর আকাশসীমা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে জর্ডান। পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে ইসরাইলীদের আশ্বস্ত করতে শুক্রবার ইসরাইলী সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র অ্যাফি ডেফরিন বলেন, ‘সকল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে এবং এগুলো হুমকি প্রতিহত করতে কাজ করছে। এটি একেবারে ভিন্ন ধরনের পরিস্থিতি আমরা কঠিন সময়ের মুখোমুখি হচ্ছি। তাই আমাদের ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।