ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বছর পূর্তির ৫ আগস্ট সামনে। ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। রক্তঝরা আগস্টকে ঘিরে আগে থেকেই সর্বোচ্চ সতর্ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপরও সক্রিয় হতে চাচ্ছে নিষিদ্ধ দলের নেতা-কর্মীরা। আগে থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকার পরও গোপনে বৈঠক করছে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। শুধু তাই নয়, স্পর্শকাতর বিষয় হচ্ছে বৈঠকে যোগ দেয়ার তথ্য মিলছে একজন সেনা কর্মকর্তার! বৈঠকে অংশ নেয়ার অভিযোগে সাদিকুল হক নামে সেনাবাহিনীর একজন মেজরকে আটক করা হয়েছে। আরও কেউ জড়িত রয়েছে কিনা সেবিষয়েও তদন্ত চলছে। এছাড়াও ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে নিষিদ্ধ দলটির ২২ নেতা-কর্মীকে। এরকম আরও কোনো বৈঠক হয়েছে কিনা, বা তৎপরতা চালাচ্ছে কিনা সেবিষয়ে তদন্ত করছে গোয়েন্দারা। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫০টি থানা এলাকায় ৪৮৯টি টহল টিম এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ৬৬টি চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও র‌্যাব, পুলিশ, আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বহু ইউনিট মাঠে রয়েছে। দেশের ৬৪ জেলায়ও তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খরা বাহিনীর সদস্যরা।

সারাদেশে ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্টের মধ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে অরাজকতা সৃষ্টিকারী চক্রের সাথে জড়িতদের বিষয়ে সর্বোচ্চ গোয়েন্দা নজরদারি চলছে। যদিও আগস্ট শুরুর আগেই একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর রাখা হয়। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট সময়কালে ফ্যাসিবাদী শক্তি নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে।

জানা গেছে, রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ বৈঠকের রহস্য উদঘাটন এবং এর পেছনে জড়িতদের বের করতে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করার কথা জানিয়েছে পুলিশ। একইসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ৮ আগস্ট ঘিরে নানা হুমকির বিষয়ে পুলিশ বলছে, আগস্ট কেন্দ্রিক কোনো ধরনের নিরাপত্তা শঙ্কা নেই। বৈঠক ও গ্রেফতার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, গত ৮ জুলাই বসুন্ধরা এলাকায় কে বি কনভেনশন হলে একটা বৈঠক নিয়ে আমাদের কাছে তথ্য ছিল। কনভেনশন হলটি শামীমা নাসরিন শম্পা নামে একজন ব্যক্তি ভাড়া নেন। সে সময় তিনি বিদেশে লোক পাঠানোর কথা বলে একটা প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করেছিলেন। যেখানে ‘ষড়যন্ত্রমূলকভাবে’ লোকজনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ জুলাই ভাটারা থানায় একটি মামলা করা হয় বলেও জানান তিনি। তালেবুর রহমান বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে এরই মধ্যে ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে দেখছি। এ ঘটনার অন্যকোনো দিক আছে কি না, এর প্রকৃত রহস্য কী এবং কারা এর পেছনে রয়েছে? ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত শিগগিরই উন্মোচন করার আশাপ্রকাশ করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। বৈঠক এবং ৮ আগস্টের বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমে নানা ‘হুমকির’ আলোচনা প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তালেবুর রহমান বলেন, আমরা গত একটা বছরে বিভিন্ন সময় দেখেছি, নানা সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্ট করার জন্য পরিকল্পিতভাবে কার্যক্রম অনেকেই করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সজাগ রয়েছি। গত ১ বছর থেকে ঢাকা মহানগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন ‘উন্নতির দিকে’ যাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বর্তমানে আগস্ট কেন্দ্রিক কোনো রকমের নিরাপত্তা শঙ্কা দেখছি না। আমরা সবসময় সতর্ক রয়েছি। আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম চলমান। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি এবং সক্ষমতা রয়েছে।

সম্প্রতি ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘বিনষ্ট’ করার জন্য কিছু লোক ‘বিভিন্ন অপচেষ্টা’ অব্যাহত রেখেছে বলেও জানান তিনি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ‘গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখার কথা জানান এবং এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনের ৮ জনকে গ্রেফতারের তথ্য দেন। তিনি বলেন, আমাদের কাছে যে প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য আছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে কারও বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, কোনো রকম আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট করার চেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে আমরা গ্রেফতার করছি। এক্ষেত্রে একটা বিষয় পরিষ্কার কাউকে ঢালাওভাবে বা কাউকে হয়রানিমূলক গ্রেফতারের কোনো অবকাশ নেই। গত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ২৫৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় ২০টি মোবাইল, ৬টি মোটরসাইকেল, একটি প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন প্রকার মাদক জব্দের তথ্য দেন তালেবুর রহমান।

এরআগে গত ২৯ জুলাই বিশেষ সতর্কতা জারি করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে প্রতিবেদন দেয় এসবি। প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, নিশিদ্ধ হওয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামলী লীগ, ছাত্রলীগ দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। পুলিশের এ বিশেষ ইউনিটটির আশঙ্কা, আওয়ামী লীগ গোপনে একত্রিত হয়ে হামলা বা সহিংসতার ঘটনা ঘটাতে পারে। তাই পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে চিঠি দিয়ে সতর্কতা জারি করে। এসবির গোপন চিঠিতে বলা হয়, ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সময়কে কেন্দ্র করে অনলাইন ও অফলাইনে সংঘবদ্ধ প্রচারণার মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা হতে পারে। দলটির কিছু নেতা ও কর্মী এ সময় সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনায় হামলা, বিশৃঙ্খলা কিংবা ভাঙচুর চালাতে পারে বলেও ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব বিষয় মাথায় রেখে সোমবার দেশের বিভিন্ন পুলিশের ইউনিটে একটি বিশেষ সতর্কবার্তা নেওয়া হয়েছে। এসবির রাজনৈতিক শাখার ডিআইজি চিঠিটিতে স্বাক্ষর করেন। চিঠিটি পাঠানো হয়েছে ডিএমপি কমিশনার, সিটি এসবি, বিভাগীয় উপপুলিশ কমিশনার, চট্টগ্রাম ও খুলনার স্পেশাল পুলিশ সুপারসহ দেশের সব জেলা পুলিশ সুপারের কাছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ঐতিহাসিক জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিকে ঘিরে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও ফ্যাসিবাদবিরোধী সামাজিক সংগঠনগুলো ১ জুলাই থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। এ ধারাবাহিকতায় ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সময়কে ‘বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ সময়ে বিতর্কিত ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো দেশব্যাপী অনলাইন ও অফলাইনে উসকানিমূলক প্রচারণা চালিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদবিরোধী কর্মসূচিতে বাধা দিয়ে বা উসকানি সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টাও হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের সব ইউনিটকে নিজ নিজ এলাকায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও যানবাহনের ওপর নজরদারি, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার এবং সাইবার গোয়েন্দা কার্যক্রম তীব্র করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে চিঠিতে। এ সময়ে ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাসসহ সন্দেহভাজন সব যানবাহনে তল্লাশি, বাস টার্মিনাল, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশন, বিমানবন্দরের আশপাশে নজরদারি এবং মোবাইল প্যাট্রল বৃদ্ধি করতে বলা হয়। একই সঙ্গে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল, সাইবার প্যাট্রলিং এবং গোয়েন্দা নজরদারি জোরদারের নির্দেশও রয়েছে।

এদিকে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) নজরুল ইসলাম বলেছেন, এসবির ওই চিঠি কোনো ধারাবাহিক গোয়েন্দা রিপোর্ট নয়, বরং সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকির পরিপ্রেক্ষিতে একটি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। এসবির কাছে কোনো গোয়েন্দা তথ্য থাকতে পারে। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই অধিকতর সতর্কতার জন্য তারা বিষয়টি আগে থেকেই জানিয়েছে। একটি রাজনৈতিক দল দেশ জুড়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারেÑ এমন শঙ্কা থেকেই রাজধানীসহ সারা দেশে ‘বিশেষ সতর্কতা’ জারি করা হয়। এ সতর্কতা কার্যকর থাকবে ৮ আগস্ট পর্যন্ত। এ সময় রাজধানীতে বিশেষ অভিযান পরিচালনার ঘোষণাও দেন তিনি। ফেসবুক-ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বছর ধরে বিভিন্ন উসকানিমূলক তৎপরতা চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলো আমরা মনিটর করছি।

এদিকে আগে থেকেই দেশে যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান চলছে। এরই মধ্যে আগস্ট ঘিরে বিশেষ শতর্কতা জারির পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা চোখে পড়ছে না বলে মনে করছেন অনেকে। নিষিদ্ধ দলটির নেতা-কর্মীরা বিভিন্নস্থানে গোপনে সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে এমন খবর বিভিন্ন মাধ্যমে শোনা যায়। এছাড়া সামাজিক মাধ্যমেও তৎপর রয়েছে নিষিদ্ধ দলটি। এ দলটির নেতাকর্মীরা পরিকল্পিতভাবে দেশ-বিদেশ থেকে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে বিভ্রান্ত করছে। ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্য ফুটেজ ও তথ্য দিয়ে ভিডিও বানিয়ে তা প্রচার করছে। তাৎক্ষনিকভাবে সাধারণ মানুষ এসব ভিডিও দেখে বিভ্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এমনকি দেশ প্রেমিক সেনাবাহিনীর কোনো কর্মকর্তা নিষিদ্ধ দলের গোপন বৈঠকে অংশগ্রহণ করার মতো স্পর্শকাতর খবরে হতবাক হচ্ছেন।