রাতারাতি পাল্টে গেছে রাজধানী ঢাকার চিরচেনা রূপ। জানজটের ঢাকা এখন অনেকটা ফাঁকা। আজ রোববার শাওয়াল মাসের চাঁদ গেছে। তাই আগামীকাল সোমবার (৩১ মার্চ) উদযাপিত হবে ঈদুল ফিতর। ইতোমধ্যে ঢাকা ছেড়েছেন প্রায় ৪০ লাখ অধিবাসী।
গত কয়েক দিন রাজধানীর বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন ও লঞ্চঘাটে ঘরমুখো মানুষের ভিড় থাকলেও এখন আর সেই চিত্র দেখা যাচ্ছে না। রাজধানীর সড়কগুলোতে এখন মানুষের চলাচল নেই। গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর ফুটপাত হকারমুক্ত। কোথাও নেই গাড়ির বিকট শব্দ। রাজধানীর সড়কগুলোতে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের অলস সময় পার করতে দেখা গেছে।
প্রিয় মানুষের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে বাড়ির পথে ছুটছে মানুষ। ঘরমুখো মানুষেরা যেন স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি ফিরতে পারে, সে জন্য মহাসড়কে দায়িত্ব পালন করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এতে কোনও রকম যানজট ও ভোগান্তি ছাড়াই নির্বিঘ্নে গন্তব্যে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এছাড়াও যে কোনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ-প্রশাসনের পাশাপাশি মাঠে রয়েছে সেনাবাহিনী।
সরেজমিন দেখা গেছে, চিরচেনা সেই রাজধানী এখন অনেকটা ফাঁকা। রাস্তায় বের হলে গণপরিবহনের দীর্ঘ সারির দেখা নেই। নেই কোনও যানজট। নেই মানুষের আনাগোনা। রাজধানীর অভ্যন্তরে চলাচলকারী অধিকাংশ গণপরিবহনে আসন ফাঁকা। এই সুযোগে বাসের স্টাফরা ঈদের বকশিশের নামে যাত্রীদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট ভাড়ার অতিরিক্ত ১০ টাকা আদায় করছেন। যানজটহীন ফাঁকা রাজধানীতে স্বাচ্ছন্দ্যে গাড়ি চলাচল করতে পারায় পরিবহন শ্রমিকরা যেমন খুশি, একইভাবে রাস্তায় গাড়ির চাপ না থাকায় খুশি ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা।
এদিকে আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে টানা ৯ দিনের ছুটি পাচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ঈদ উপলক্ষে আগেই পাঁচ দিন টানা ছুটি ঘোষণা করেছিল সরকার। সেখানে এখন নির্বাহী আদেশে ৩ এপ্রিলও ছুটি ঘোষণা করা হয়। গত ২০ মার্চ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ ছুটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর ফলে এবার ২৮ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ৯ দিন ছুটি পাচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এই হিসাবে কাগজপত্রে শনিবার (২৯ মার্চ) শুরু হয়েছে ঈদুল ফিতরের ছুটি। কিন্তু নির্ধারিত ছুটি শুরুর আগের দিন ২৮ মার্চ সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার। একই সঙ্গে একই দিন পবিত্র শবে কদরের ছুটি ছিল। এদিকে ২৯ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে ঈদুল ফিতরের পাঁচ দিনের ছুটি। ২ এপ্রিল পর্যন্ত এই ছুটি থাকবে। এর মধ্যে ঈদের দিন সাধারণ ছুটি। আর ঈদের আগের দুদিন এবং পরের দুদিন নির্বাহী আদেশে সরকারি ছুটি। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ছুটি শেষে অফিস খোলার কথা ৩ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার)। তার পরের দুই দিন আবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার। এখন ৩ এপ্রিলও নির্বাহী আদেশে ছুটি হওয়ায় ২৮ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ৯ দিন ছুটি ভোগ করবেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এই ছুটি শুরুর দুই দিন আগে ছিল ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের ছুটি। পরদিন বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) এক দিন অফিস খোলা ছিল। ফলে সব মিলিয়ে টানা ১১ দিনের জন্য ঈদের ছুটি উপভোগ করছেন অনেকে।
এদিকে ঈদের ছুটি শুরু হয়ে যাওয়ায় রাজধানী ফাকা হওয়ার কারণে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ঘরমুখো মানুষ নানা প্রতারণা ও অপরাধের শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। গত ২৬ মার্চ ধানমন্ডি এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে ডাকাতির ঘটনা রাজধানীর মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। এ কারণে ঈদে রাজধানীতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ঈদের ছুটিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সর্বোচ্চ সংখ্যক পুলিশ সদস্য নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নিশ্চিত নিরাপত্তার জন্য করণীয় বিষয়ে নানা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন আইজিপি। এই নির্দেশনার পর সারা দেশে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ছাড়াও আনসার সদস্যরা এ সময় মাঠে নেমেছেন। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ সদর দফতর থেকে বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঢেলে সাজানো হয়েছে রাজধানীসহ সারা দেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সিসি ক্যামেরাও স্থাপন করা হয়েছে। সর্বাধিক সংখ্যক টহলেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজধানীর নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোয় বসবে সাত শতাধিক চেকপোস্ট, যা ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে।
জানতে চাইলে গুলিস্তান সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে দায়িত্ব পালনরত ট্রাফিক কনস্টেবল শাহাজাহান মিয়া বলেন, ‘লোকজন বাড়ি চলে গছে। যারা বাকি আছে তারাও যাচ্ছে। এ কারণে রাস্তায় গাড়ি কম, সিগনাল নাই। তাই কিছুটা নিশ্চিন্তে সময় পার করছি।’
তিনি বলেন, ‘সারা বছরের মধ্যে দুই ঈদেই এমন সুযোগ মেলে। বছরের বাকি সময় ডিউটি করতে হয় নানা ধরনের ঝুঁকি নিয়ে।’
জানা গেছে, এবার প্রথমবারের মতো ঈদের ছুটিতে ঢাকা মহানগরীর নিরাপত্তায় পুলিশের সঙ্গে মাঠে থাকছে ৪৩১ জন অক্সিলারি পুলিশ। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এলাকার নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে থেকে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। গ্রেফতারের ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে তাদের। তবে তারা কোনও তদন্ত করতে পারবেন না। কাউকে গ্রেফতারের পর দ্রুত পুলিশের কাছে হস্তান্তর করবেন।
র্যাবের পক্ষ থেকেও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখা থেকে জানানো হয়, ঈদে মানুষের নিরাপত্তায় গোয়েন্দা কার্যক্রম ও টহল জোরদার করা হয়েছে। এ সময় ইউনিফর্মের পাশাপাশি সাদা পোশাকে র্যাব ও গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা তৎপর থাকবেন।
জানতে চাইলে কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ানো ঠিকানা গাড়ির হেলপার মকবুল হোসেন বলেন, ‘ঈদের সময় বাড়ি যাবো না। বাড়তি ডিউটি করবো। তাই গাড়ি নিয়ে সাভারের দিকে যাচ্ছি। যাত্রীর পরিমাণ কম, তবে রাস্তা ফাঁকা হওয়ায় গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় কম লাগছে। বেশি ট্রিপ মারতে পারছি। এর বাইরে প্রত্যেক যাত্রীদের কাছ থেকে ঈদ বকশিশের কথা বলে ৫ থেকে ১০ টাকা বাড়তি চেয়ে নিচ্ছি। এতে আয় ভালো হচ্ছে। আশা করছি ছুটির এই কয়দিনে আমাদের ভালো উপার্জন হবে।’
ঠিকানা গাড়ির যাত্রী ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে গাবতলী যাচ্ছি। নির্দিষ্ট ভাড়া ৫০ টাকা। কিন্তু ঈদের বকশিশ বাবদ আরও ১০ টাকা বাড়তি নিয়েছে। আমরাও দিয়েছি। রাস্তায় যানজট নেই। তাই তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবো এতেই খুশি আমরা।’