গুমের শিকার নারীদের ক্ষেত্রেও দেখানো হয়নি সামান্যতম সহমর্মিতা। পর্দানশীন একজন নারীকে গুম করে আনার পর তার কাছ থেকে ওড়নাটি কেড়ে নিয়ে পুরুষের সামনে অশালীন অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয়। ২৫ বছর বয়সী ওই নারীকে ২০১৮ সালে পুলিশ অপহরণ করে ২৪ দিন গুম করে রাখা হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আয়নাঘরে। ভুক্তভোগী ওই নারী কমিশনকে বলেন, ‘নির্যাতনের সময় তার হাত দুদিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো। তারা আমার ওড়না কেড়ে নিয়ে হাসাহাসি করত। যেহেতু জানালার দিকে মুখ করা ছিল, তাই আমাকে এভাবে দেখার জন্য অহরহ পুরুষ মানুষ যে কতজন এসেছে তা বলা কঠিন। তারা হাসাহাসি করত। বলাবলি করছে যে, এতদিন এমন পর্দাই করছ যে- এখন সব পর্দা ছুটে গেছে’।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত গুম-সংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনে নির্যাতনের ভয়াবহ এমন চিত্র উঠেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষায়িত একটি ইউনিটের সহযোগিতায় এ নির্যাতন চালানো হত্ োএ ধরনের ঘটনার পেছনে শুধু দেশীয় নিরাপত্তা বাহিনীই নয়, বরং বিদেশি অংশীদারদের ভূমিকা এবং বাহিনীর মদদ রয়েছে। পর্দানশীন ওই তরুণী কমিশনকে বলেন, আমার দুই হাত দুদিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সরানো হয় গায়ের ওড়নাটাও। সামনে দিয়ে পুরুষরা যাওয়া-আসা করছে আর যা-তা বলছে। এত বেশি নির্যাতন করা হয় যে, নির্ধারিত সময়ের আগেই মাসিক শুরু হয়। নির্যাতনকারীদের কাছে প্যাড চাইলে এটা নিয়ে অনেক হাসাহাসি করতেন। মেয়েটি বলেছিলেন তিনি পর্দা করেন তবুও তার ওড়না কেড়ে নেওয়া হয়।
সেলের মধ্যে আটক রেখে বর্বর নির্যাতন করা হতো গুম হওয়া অসহায় মানুষদের ওপর। যার মধ্যে রয়েছে চেয়ারে বসিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, নখ উপড়ে ফেলা, শব্দনিরোধক কক্ষে নিয়ে চোখে গামছা বেঁধে কখনো যমটুপি পরিয়ে হাত ওপরে বেঁধে বেধড়ক পেটানো, উল্টো করে বেঁধে নির্যাতন, মুখের ওপর গামছা দিয়ে ওপর থেকে পানি ছাড়া, প্রস্রাবের সময় বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, নির্মমভাবে মারধর, নখের নিচে সূঁচ ঢোকানো, বাঁশডলা ও যৌনভিত্তিক নির্যাতন ইত্যাদি। ওই নারী কমিশনকে আরও বলেন, ‘আমার পিরিয়ড হওয়ার ডেট ছিল অনেক দেরিতে। কিন্তু আমার ওপর তারা এমনভাবে টর্চার করে যে তাতে আমি এত পরিমাণ অসুস্থ হয়ে যাই, সঙ্গে সঙ্গে আমার পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়। তারপর তাদের বলি যে, আমার তো প্যাড লাগবে-তখন এটা নিয়ে অনেক হাসাহাসি করতেন বাহিনীর সদস্যরা।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গুম হওয়াদের রাখা হতো শব্দনিরোধক স্থানে। ফলে নির্যাতনের সময় ভুক্তভোগীদের চিৎকার বাইরের কেউ শুনতে পেতেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের গুম করার কোনো আনুষ্ঠানিক রেকর্ড থাকত না। ফলে নিরাপত্তা বাহিনী দায়মুক্তভাবে নির্যাতন চালাতে পারত। বর্বর নির্যাতনের জেরে গুম হওয়াদের শরীরে ফুটে ওঠা ক্ষত মুছতে তাদের ক্ষতস্থানে দেওয়া হতো ওষুধ বা মলম। জনসমক্ষে আনার পর ক্ষত বা নির্যাতনের চিহ্ন যেন না দেখা যায় তার জন্যই এমনটি করা হতো। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের চিহ্ন মুছে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেই তাদের মুক্তি দেওয়া হতো। তবে অনেক ভুক্তভোগী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হয়ে স্পষ্ট নির্যাতনের চিহ্ন দেখালেও সেসব অভিযোগ উপেক্ষা করা হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আওয়ামী আমলে কথিত সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে টার্গেট করা ব্যক্তিদের গুম করার পর বিশেষ সেলে রাখা হতো। সেখানে তাদের ওপর চলতো ভয়াবহ নির্যাতন। শিফটিং সিস্টেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন পদ্ধতিতে নির্যাতন চালানো হতো। কখনো ঝুলিয়ে পেটানো হতো, আবার কখনো আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হতো; এমনকি কখনো বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো। এতে অনেকে অজ্ঞান হয়ে যেতেন, বমি করে দিতেন, আবার কেউ কেউ চোখ বাঁধা অবস্থায় নিজের শরীরের মাংস পোড়ার গন্ধ পেতেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভয়াবহ নির্যাতনের প্রমাণ ধ্বংসের চেষ্টা সত্ত্বেও কমিশন এমন কিছু উপাদান সংগ্রহ করেছে, যা ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্যের সঙ্গে মিলে যায়। বিশেষ করে র্যাব-২ এবং কমান্ড অ্যান্ড প্লাটুন কোম্পানি (সিপিসি)-৩ এ ব্যবহৃত ঘূর্ণায়মান চেয়ার, টিএফআই সেলে মানুষকে ঝুলিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত পুলি-সিস্টেম এবং একাধিক স্থানে শব্দনিরোধক ব্যবস্থা।
টয়লেটেও বসানো ছিল সিসি ক্যামেরা: ৩৯১ দিন গুম থাকা ৪৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি কমিশনকে জানিয়েছেন, পুরুষ ভুক্তভোগীদের রাখার সেলগুলো ছিল ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ। সেলে টয়লেট ব্যবহারের জন্য নিচু বিল্ট-ইন প্যান বসানো ছিল। মাঝে কোনো দেওয়াল না থাকায়, ভুক্তভোগীরা যখন শুয়ে থাকতেন, তখন তাদের শরীর প্রায়শই ওই প্যানের ওপরেই পড়ে থাকত। ফলে তাদের ময়লা, প্রস্রাব ও মলের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যে থাকতে হতো। এছাড়া এসব সেলে সিসি ক্যামেরা দিয়ে প্রতিটি কর্মকা- পর্যবেক্ষণ করা হতো। ফলে ভুক্তভোগীদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্তেও, যেমন প্রাকৃতিক কাজের জন্য টয়লেট প্যান ব্যবহারের সময়ও চরম অপমান ও লজ্জার মধ্যে থাকতে হতো। নিরাপত্তা প্রহরীরা ঠিকমতো ঘুমাতেও দিত না।
জম টুপি দিয়ে চোখ বাঁধা থাকত: ২০২৩ সালে সিটিটিসিতে ১৬ দিন গুম ছিলেন ৪৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, চোখ কখনো গামছা দিয়ে, কখনো জম টুপি দিয়ে বাঁধা থাকত। হাত কখনো সামনে, কখনো পেছনে। আর যখন বেশি মারবে, তখন এই হাত পেছনে দিয়ে রাখত আর আমার এই কনুইগুলো, দুই হাঁটু এগুলোতে খুব জোরে জোরে মারত মোটা লাঠি দিয়ে। আমি মনে করতাম যে, আমার হাড়গুলো বুঝি ভেঙে যাবে, কিন্তু পরে দেখলাম যে ফুলে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে, কিন্তু হাড় ভাঙছে এ রকম বুঝি নেই। এক পর্যায়ে আমাকে বলল যে, তোর হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলব। র্যাব-১১ এ গুম হওয়া এক যুবক বলেন, তার পা বেঁধে ওপর দিকে ঝুলিয়েছে। মাথা নিচের দিকে, পা ওপর দিকে দিয়ে। শরীরে কোনো পোশাক রাখে নাই তখন। তারপর এলোপাতাড়ি আমাকে দুজনে একসঙ্গে পেটাতে থাকে। খুব সম্ভব বেতের লাঠি দিয়ে। পরে আমাকে অসংখ্যবার টর্চার করেছে এবং মারতে মারতে আমার এমন হয়েছে, চোখের কাপড় খুলে গেছে। নাকে-মুখে চড়ানো, থাপড়ানো। ওই সময় চামড়া ছিঁড়ে, মানে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরেছে। এই ভুক্তভোগীকে সিটিটিসিতে টানা প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করা হয়েছিল, নির্যাতনকারীরা পালাক্রমে চার ঘণ্টার শিফটে তাকে মারধর করত। তার শরীরজুড়ে এখনো স্থায়ী আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এই নির্যাতনের ঘটনা একজন সহবন্দি নিশ্চিত করেন, যিনি সেই সময় তার কষ্ট স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
আঙুলের নখ উপড়ে ফেলে সুচ ঢোকানো হতো: র্যাব-১১ এ ৪২ দিন গুম থাকা আরেক ব্যক্তি বলেন, হাত সম্ভবত গামছা বা কাপড় দিয়া বেঁধেছে। বেঁধে, আমার এই হাঁটুর ভেতরে দিয়া হাত ঢুকাইয়া এই দুই হাঁটুর মাঝখান দিয়া লাঠি ঢুকাইয়া একটা উঁচু কোনো স্ট্যান্ডের মধ্যে রাখছে। যেটার কারণে আমার পাগুলো ওপরে ছিল। আর মাথা নিচু হয়ে গেছে। পায়ের তালুর মধ্যে এবার বাড়ি শুরু করেছে। চিকন একটা লাঠি হবে সম্ভবত। আবার ওই প্রথম থেকে একই প্রশ্ন, নামগুলা বল, তোমার সঙ্গে কে কে আছে। ৫৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, নির্যাতনের এক পর্যায়ে আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়। র্যাব-১০ এ গুমের শিকার এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, গ্রিলের মধ্যে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখত। আমি যেন বসতে না পারি। পা খুব ফুলে গিয়েছিল আমার। হাতে দাগ পড়ছে। এই যে দাগগুলো... ওয়াশরুমে যেতে চাইলে, ওয়াশরুমে যেতে দিত না। এই অত্যাচার শুরু হয়ে গেলো। এর মধ্যে একদিন এসে আঙুলটাকে এভাবে প্লাস দিয়ে ধরছে। ধরার পরে টেবিলের ওপর হাত রেখে, প্লাস ধরে, আরেকজন সূঁচ ঢুকিয়েছে। এই যে সুঁইয়ের দাগ। কয়, ‘তুই আবদুল মুমিন না? স্যার, আমি আবদুল মুমিন না, আমার নাম হলো হাবিব’।