পলিসি প্লেনাম আয়োজিত ‘শিক্ষা, গবেষণা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে বিশিষ্টজনরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। এটি এখন একটি বহুমুখী ও অগোছালো ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে, যার কোনো নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা বা জাতীয় লক্ষ্য নেই ।
তারা বলেন, প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো একজন মানুষকে নৈতিকভাবে সৎ, মূল্যবোধে উজ্জীবিত এবং সমাজের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা; কিন্তু আমাদের বর্তমান ব্যবস্থা সেই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ। স্বাধীনতার পর ভারতের প্রেসক্রিপশনে বাধ্যতামূলক আরবি ও ইসলামিয়াত শিক্ষা তুলে দেওয়া হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করা।
গতকাল শুক্রবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এ জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। কূটনৈতিক সাকিব আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপে উপস্থিত ছিলেনÑ এ এফ এম সোলাইমান চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুল্লাহ হিল আমান আজমি কূটনৈতিক সাকিব আলী, মাহসিনা মমতাজ মারিয়া, ফেরদৌস আরা খানম, সংলাপে গবেষণা পত্র তুলে ধরেন লে. কর্নেল (অব. ) নুরুজ্জামান প্রমুখ।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুল্লাহ হিল আমান আজমি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। এটি এখন একটি বহুমুখী ও অগোছালো ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে, যার কোনো নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা বা জাতীয় লক্ষ্য নেই। শিক্ষার মাধ্যমে যেখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত জ্ঞান, মূল্যবোধ, কৌতূহল ও সৃজনশীলতা বিকশিত হওয়ার কথা, সেখানে বরং এ ব্যবস্থা তাদের চিন্তা ও অনুসন্ধানী মনোভাবকে দমন করছে।
তিনি বলেন, শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত একজন মানুষকে নৈতিকভাবে সৎ, মূল্যবোধে উজ্জীবিত এবং সমাজের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা; কিন্তু আমাদের বর্তমান ব্যবস্থা সে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ। স্বাধীনতার পর ভারতের প্রেসক্রিপশনে বাধ্যতামূলক আরবি ও ইসলামিয়াত শিক্ষা তুলে দেওয়া হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করা। পরে জিয়াউর রহমান এ বিষয়গুলো পুনরায় চালু করলেও তা যথেষ্ট কার্যকর হয়নি।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি হিসেবে উল্লেখ করে আবদুল্লাহ হিল আমান আজমি বলেন, এখানে জাতীয় পাঠ্যক্রম, ইংরেজি মাধ্যম, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড ও বিভিন্ন ধারার মাদ্রাসা দাখিল, কওমি, হেফজ সব মিলিয়ে এমন এক বিশৃঙ্খল ধারা তৈরি হয়েছে, যার ফলে শিক্ষার কোনো একক জাতীয় মানদন্ড নেই। শিশুরা স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহলী, কিন্তু তাদের প্রশ্ন করার স্বাধীনতা পরিবার ও বিদ্যালয় উভয় জায়গাতেই দমন করা হয়। ‘চুপ করো’ সংস্কৃতির কারণে তাদের জানার আগ্রহ অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া, আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি মুখস্থনির্ভর; এখানে সৃজনশীল চিন্তা, বিশ্লেষণ বা নিজের মত প্রকাশের সুযোগ নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা অর্জন করেও বাস্তব জ্ঞান, যেমন ইংরেজিতে রচনা লেখা বা সাবলীলভাবে কথা বলার মতো মৌলিক দক্ষতায় পিছিয়ে থাকে।
তিনি আরও বলেন, এই ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থার কারণেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে পড়েছে, আর উন্নত দেশগুলো জ্ঞানের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ ব্যবস্থাকে সামান্য সংস্কার করে ঠিক করা সম্ভব নয়। একে সম্পূর্ণ ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে।
সম্মিলিত নারী প্রয়াস এর সেক্রেটারি ফেরদৌস আরা খানম বলেন, শিক্ষকের ভূমিকা কেবল ‘জ্ঞানদাতা’ হিসেবে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং ছাত্রের ম্যানেজার বা গাইড হিসেবে কাজ করা উচিত। এই নতুন ভূমিকায় শিক্ষক তার আদর্শ, চরিত্র এবং কথার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের এমনভাবে পথ নির্দেশনা দেবেন যাতে সেই প্রভাব তাদের আত্মায় প্রতিফলিত হয় এবং তারা শিক্ষার বাস্তবতা অন্তরের সঙ্গে উপলব্ধি করতে পারে। এর জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আদর্শ প্রভাবের প্রসার ঘটানো জরুরি। একই সঙ্গে শিক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হলে প্র্যাক্টিক্যাল নলেজ অ্যাসাইনমেন্ট, একটি সম্মানিত ক্লাসরুম এবং সিলেবাস ও কারিকুলামকে স্কিল-বেসড ও কনফিডেন্স-বেসড করে তৈরি করা দরকার।
তিনি বলেন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করতে সবচেয়ে বেশি দরকার ধর্মীয় নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পর্কযুক্ত কারিকুলামকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং একে প্রাধান্য দেওয়া। কারণ সততা, সহনশীলতা, দেশপ্রেম ও মানবিকতাÑ এই মূল্যবোধগুলো থেকেই একজন ব্যক্তির মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা তৈরি হয়।
ফেরদৌস আরা খানম বলেন, দেশপ্রেম তৈরির জন্য প্রত্যেকের শিক্ষার সাথে সততা, সহনশীলতা, পরশ্রদ্ধা ও দেশপ্রেম ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকা আবশ্যক, আর এই মূল্যবোধগুলি শিক্ষার মধ্যে সম্পৃক্ত করার জন্য নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য।
সাবেক রাষ্ট্রদূত সাকিব আলি বলেন, ভালো ছাত্রছাত্রীদের সামনে আনা ও তাদের প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে সমাজে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে। শিক্ষার্থীরা তখন ভাববে আমি যদি মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করি, আমিও একদিন ভালো চাকরি বা সম্মানজনক অবস্থানে যেতে পারব।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে, রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেই সুযোগ-সুবিধা মেলে, পড়ালেখা নয় এখন অনেকে বলে ‘পড়াশোনা করবো কেন? আওয়ামী লীগে বা বিএনপিতে গেলে তো সুযোগ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে বর্তমান দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান থাকবে, আপনারা শিক্ষাকে মর্যাদা দিন। যদি রাজনৈতিক নেতারা শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন, এমনকি শিক্ষকের পা ধরে সালাম করেনÑ তাহলে দেখবেন, পুরো সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা ও শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।’
মানবিকতার গুরুত্বের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানবিকতার। ইসলামও আমাদের শেখায় মানবিকতা, আর আল্লাহর প্রতি প্রকৃত আত্মসমর্পণই সেই মানবিকতার সর্বোচ্চ প্রকাশ।