রাজধানী ঢাকার লাগোয়া গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত নাগরী ইউনিয়ন আজ ‘মাদকের রাজধানীথ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। এক সময় যা ছিল নিভৃত গ্রামাঞ্চল, এখন তা রূপ নিয়েছে চোলাই মদ, গাঁজা ও ইয়াবার বিশাল পাইকারি বাজারে। প্রশাসনিক অবহেলা, রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও ভৌগোলিক সুবিধার ফলে পুরো ইউনিয়নটিই হয়ে উঠেছে অপরাধীদের অভয়াশ্রম। নাগরী ইউনিয়নের ভৌগোলিক অবস্থান অপরাধীদের জন্য আদর্শ নিরাপদ অঞ্চল—ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের সংযোগস্থলে হওয়ায় মাদক কারবারিরা সহজে রাজধানীসহ আশপাশে মাদক সরবরাহ করতে পারছে। এলাকাটিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি দুর্বল হওয়ায় দুর্বৃত্তরা নির্বিঘ্নে তাদের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, আগে আওয়ামী লীগের কিছু নেতার ছত্রছায়ায় এসব অপকর্ম পরিচালিত হতো, বর্তমানে বিএনপির প্রভাবশালী একটি চক্রের নিয়ন্ত্রণে চলছে পুরো মাদক সিন্ডিকেট। এলাকার গাড়ালিয়া, কালিকুটি, পানজোড়া, সেনপাড়া, নাগরীবাজার, উলুখোলা, কড়ান, বড়কাউসহ অন্তত ১৫টি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে প্রায় ৭০ জন মাদক ব্যবসায়ী। এখানে গড়ে উঠেছে শতাধিক মদের চোলাই কারখানা, যেখান থেকে প্রতিদিন রাজধানী ঢাকায় সরবরাহ করা হয় কয়েক হাজার লিটার চোলাই মদ।

সম্প্রতি গাড়ালিয়া গ্রামের শাওন মোল্লার বাড়িতে গোপন চোলাই মদের কারখানায় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম জব্দ ও তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে। এলাকাবাসীর দাবি, শাওনের নেতৃত্বে এখানে মদ, গাঁজা ও ইয়াবার খুচরা ও পাইকারি বেচাকেনা চলে। তার সহযোগী মুকুল মোড়ল ও কবির হোসেন দীর্ঘদিন ধরেই চাঁদাবাজি ও জমি দখলের মতো অপরাধে জড়িত। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় তারা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে সাধারণ কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।

এর আগে কালিকুটি এলাকার সোহেল রানার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৩০০ লিটার চোলাই মদ উদ্ধার করে এবং তার স্ত্রী সাগরিকাকে গ্রেফতার করে। তবে সোহেল ও তার ভাই জুয়েল রানা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

মাদকের দৌরাত্ম্য শুধু নাগরী ইউনিয়নেই সীমাবদ্ধ নয়। কালীগঞ্জের ভাদার্তী, কালীগঞ্জ বাজার, খেয়াঘাট, দেনারবাড়ী, কাপাসিয়া মোড়, টেকপাড়া, আরএফএল গেট, ঘোনপাড়া, চান্দাইয়া, বড়নগর, গোলাবাড়ী, বালিগাঁও, ময়েজ উদ্দিন সেতুর পাশের খেয়াঘাট এলাকাগুলোতেও মাদক ব্যবসা এখন খোলা বাজারের মতোই চলতে দেখা যায়।

কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), মো. আলাউদ্দিন বলেন, “মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। নাগরী ইউনিয়নসহ পুরো উপজেলায় মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করা হয়েছে। আমরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি এবং বড় ধরনের অভিযানে নামার প্রস্তুতিও রয়েছে। তবে অপরাধীরা ক্রমাগত তাদের কৌশল পাল্টাচ্ছে, ফলে এই লড়াইয়ে স্থানীয়দের তথ্যভিত্তিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা শুধু অভিযান নয়, জনসচেতনতা ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এই যুদ্ধ থেমে থাকবে না।

তবে স্থানীয়দের অভিযোগ ভিন্ন। তারা বলেন, অভিযানগুলো অনেক সময় লোক দেখানো হয়, আর রাজনৈতিক প্রভাব ও দালালচক্রের ছত্রছায়ায় প্রকৃত অপরাধীরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক চাপের কারণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে প্রশাসন অনেক সময় পিছিয়ে যায়, যার ফলে এলাকার মাদক পরিস্থিতির উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।