আজ ১৮ জুলাই শুক্রবার। ২০২৪ সালের এই দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের “কমপ্লিট শাটডাউন” শুরু হয় এদিন। এর আগে ১৭ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেয় তারা। কর্মসূচি চলাকালে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এদিন সংঘর্ষে সারাদেশে ৩১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ ছিল প্রায় অচল। তাদের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ২৪ জন, চট্টগ্রামে ও নরসিংদীতে দু’জন করে এবং রংপুর, সাভার ও মাদারীপুরে একজন করে নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ১১ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। এদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে আহত হন প্রায় দেড় হাজার মানুষ। এর আগে ১৬ জুলাই আন্দোলনে সারাদেশে ছয়জন নিহত হন। এ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদের সংখ্যা ৩৭ জনে পৌঁছায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এদিন ঢাকাসহ সারাদেশে ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়। এছাড়া ডিএমপি অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজধানীতে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এদিন বেলা ১২টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঢাকার সঙ্গে দেশের অধিকাংশ জেলার রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। রাত ৯টার পর থেকে ইন্টারনেট সেবা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অবরোধকারীদের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারা দেশ প্রায় অচল ছিল। এদিন দুর্বৃত্তরা মহাখালীতে সেতু ভবন, স্বাস্থ্য ভবন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ভবন, দুর্যোগ ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়। শতাধিক গাড়ি পোড়ানো হয়। দুই দফা আগুন দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনে। এর জেরে অন্তত ১২ ঘণ্টা বিটিভির সম্প্রচার বন্ধ ছিল। এদিন সকাল থেকে বন্ধ রাখা হয় মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট। বিভিন্ন স্থানে ডেটা সেন্টারে অগ্নিসংযোগের পর বন্ধ হয়ে যায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা। ফলে কার্যত ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে গোটা দেশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এদিন সারাদেশে বিজিবি মোতায়েন করা হয়।

এদিন শেখ হাসিনার সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর গুলী চালানোর অনুমতি দিয়ে শেখ হাসিনা যে নির্দেশ দিয়েছিলেন । ফাঁস হওয়া ওই কলটি শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে করেছিলেন গত বছরের ১৮ জুলাই। ওই সময় ছিল বিক্ষোভের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। পুলিশের গুলীতে বিক্ষোভকারীদের মৃত্যুর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। কলটির পরের কয়েক দিনে ঢাকায় সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় এমন রাইফেল ঢাকা জুড়ে মোতায়েন ও ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিবিসি জানিয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশের একাধিক নথিতে বিষয়টি উঠে এসেছে।

১৮ জুলাই 'সম্পূর্ণ শাটডাউন' কর্মসূচির প্রেক্ষিতে ঢাকায় ও অন্যান্য ৪৭টি জেলায় ব্যাপক সহিংসতা ঘটে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী পরিবহন বন্ধ কার্যকর করার জন্য অন্যান্য বিভিন্ন গ্রুপের সাথে যোগ দেয়। পুলিশ ও অজ্ঞাত ব্যক্তিরা বুলেট, শটগানের গুলী ও রাবার বুলেট দিয়ে তাদের উপর গুলী চালালে কমপক্ষে ২৯ জন শহীদ হওয়ার নিশ্চিত খবর পাওয়া যায়। পুলিশ ও ছাত্রলীগের লোকজন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। আন্দোলনকারীরা বিটিভি ভবন, সেতু ভবন ও অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। সারা দেশে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয় এবং মেট্রো রেলের কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়। ঢাকা ছাড়াও দেশের ৪৭টি জেলায় বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, পুলিশের গুলি ও হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় আহত হয় অন্তত ১৫০০ জন। কোথাও কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে এবং কিছু জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। সারাদেশে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্য মোতায়েন করা হয়।

১৮ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়। ওরা গ্রাফিতি করার জন্য তখন ফান্ড কালেকশন করেছিল। ১৭ তারিখের পর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছিল। আন্দোলনের শীর্ষ নেতারাও স্বীকার করেন যে, ১৭ তারিখের পর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে ভূমিকা নিয়েছে, তারা যদি সে ভূমিকা না রাখতো তাহলে আন্দোলন টিকে থাকতো কি-না সন্দেহ। আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পরিস্থিতি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে তাদের প্রতি সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তা তারা ভুল প্রমাণ কওে দেয়। তারা দেখিয়ে দেয় তারাও বুকের তাঁজা রক্ত দিয়ে বাংলাদেশকে যে কোন অপশক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

১৮ জুলাই শিক্ষার্থীরা পুনরায় মিছিল বের করে। তবে সংখ্যায় কম হওয়ায় পুলিশের সাথে লড়াই করা কঠিন ছিল। এক পর্যায়ে ক্যাম্পাস সংলগ্ন গেরুয়া এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজন এসে আন্দোলনে যোগ দিলে পুলিশ পিছু হটতে শুরু করে। তারা ক্যাম্পাসের বাইরে চলে যায়। তখন শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের সকল গেটে তালা লাগিয়ে দেয় এবং ঐদিনই হলের তালা ভেঙে সেখানে অবস্থান করে আন্দোলনের শীর্ষ নেতাদের শঙ্কা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হলে আন্দোলনের মাত্রা স্তম্ভিত হয়ে যাবে কী-না। আন্দোলন চালানো সম্ভব কি-না। তখন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা জানায় আন্দোলন চলবে। পরদিন যেভাবে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পরে তাতে সামগ্রিকভাবে এদেশের মানুষদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। দেখা গেলো নিজেদের উদ্যোগে স্বতস্ফূর্তভাবে তারা আন্দোলনে জড়িয়েছে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই অবদান শতবছর ধরে মনে রাখা উচিত বলে মনে করেন অংশীজনরা।

১৮ জুলাই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশব্যাপী প্রতিরোধ, সহিংসতা, সংঘর্ষ ও গুলীর ঘটনা ঘটে। রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ভেতরে থাকা পুলিশদের হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার করেছে র‌্যাব। বৃহস্পতিবার বেলা তিনটার কিছু আগে এ ঘটনা ঘটে।

‘কমপ্লিট শাটডাউনে’র অংশ হিসেবে রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকায় সরকারি চাকরিতে কোটার বিরোধিতা করে আন্দোলনে নামেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর কিছু পুলিশ সদস্য কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ভেতরে অবস্থান নেন। পুলিশ ভবনের ভেতর থেকে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করলে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে সেই ভবনে ভাঙচুর করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকেই পুলিশ ছররা গুলী ও রাবার বুলেট ছুড়ে। এতে আহত হয়েছে অনেকে। এরমধ্যে মেরুল বাড্ডার কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতে ৩ ঘণ্টা ধরে পুলিশকে অবরুদ্ধ করে রাখেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। খবর পেয়ে দুপুর আড়াইটার দিকে হেলিকপ্টার নিয়ে এসে তাদের উদ্ধার করে র‌্যাব। প্রথমে কয়েকজনকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার পর আবারও হেলিকপ্টার টহল দেয়।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পুলিশ বিনা উস্কানিতে ব্র্যাকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে। এমনকি তারা ক্যাম্পাসের ভেতরেও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে। পুলিশের হামলায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে বাড্ডা-রামপুরা ছাড়াও রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়াসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। সারা দেশ থেকেও সংঘর্ষের খবর আসে সেদিন।

১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার আলোচনায় বসতে রাজি বলে জানান তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। শিক্ষার্থীরা যখনই চাইবে তাদের সঙ্গে সরকার বসতে রাজি আছে বলে জানিয়ে দেন তিনি। এদিন জাতীয় সংসদ ভবনের টানেলের নীচে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। আইনমন্ত্রী বলেন, সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকার নীতিগতভাবে একমত। ফলে আন্দোলনকারীরা যখন রাজি হবে, তখনই সরকার তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবে।

সরকার কি আদর্শিকভাবে কোটা সংস্কারের পক্ষে যাচ্ছে কি না জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, মামলাটি আদালতে আছে। তাও সর্বোচ্চ আদালতে। আদালতে যখন মামলার শুনানি শুরু হবে সরকার পক্ষ কোটার ব্যাপারে একটা প্রস্তাব দেবে। এবং আমার মনে হয় আমরা যেহেতু সংস্কারের পক্ষে, কোটা সংস্কার করার জন্য প্রস্তাব দেব। সেজন্য আপনারা বলতে পারেন আমরা (সরকার) কোটা সংস্কারের পক্ষে। আইনমন্ত্রী আরও বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনা খতিয়ে দেখতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গ্রহণ করা হয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি খন্দকার দিলিরুজ্জামানকে এই কমিটির দায়িত্ব দেওয়া প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রী বলেন, আমরা দেখেছি এবং বিশদভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করেছি, কোমলমতি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের যে দাবি ছিল, সরকার তাদের কথা বিবেচনা করে দাবিগুলো মেনে নিতে রাজি হয়েছে। তাই আমার মনে হয়, আজ থেকে আন্দোলন করার আর কোনো প্রয়োজন নেই। সে কারণে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানাচ্ছি, পিতৃতুল্য নাগরিক হিসেবে তাদের অনুরোধ জানাচ্ছি, যাতে তারা সহিংসতা বন্ধ করে এবং এই আন্দোলন প্রত্যাহার বা স্থগিত করে।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পরদিন তো সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ সারাদেশ ছিল প্রায় অচল। এদিন মিরপুর ১০ চত্বরে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়। এবং দুপুর ২টার আগেই ছাত্র-জনতা মিরপুর ১০ এর আশেপাশের সব এলাকা তাদের দখলে নিয়ে নেয়। পুলিশ শুধু মিরপুর ২ এর থানার সামনে অবস্থান নিতো। আর ১১টার পরে পুলিশ-বিডিআর-আর্মি থাকতো। এদিকে ওইদিন তিনটার দিকে কাজীপাড়ায় হেলিক্যাপ্টার দিয়ে গুলী ছোঁড়া হয়। শেওড়াপাড়ায় হাসপাতালে নেওয়ার আগে এক শিক্ষার্থী শহীদ হলে সেই লাশ নিয়ে তারা মিরপুর ১০ দিকে রওনা হয়। উপর থেকে হামলা করে র‌্যাব আর নিচে হামলা করে পুলিশ। এদিন মিরপুর এলাকায় রাত ১০টার দিকে পুলিশ গলিতে গলিতে ঢুকে গুলী করা শুরু করে। এমন কি মানুষের বাসায় গিয়ে গুলী চালায়।

যাত্রাবাড়ী রাস্তায় মাদরাসা শিক্ষার্থীরা শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছিল জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের আওয়ামীলীগ গত বছরগুলোতে ব্যাপক নির্যাতন করে। মাদরাসা শিক্ষার্থীরা যাত্রবাড়িতে যে ভূমিকা রাখে তাও অবিস্মরণীয়। বাড্ডা, রামপুরা ও যাত্রাবাড়িতে যদি আন্দোলন কম হতো। হয়তো এই গণঅভ্যুত্থানের চিত্র ভিন্নভাবে হতো বলেও মনে করেন আন্দোলনের স্টেকহোল্ডাররা।

ছাত্র নেতারা মনে করতে থাকেন ১৭ জুলাইয়ের পর আন্দোলন যে মাত্রায় গিয়ে ঠেকে তা সরকার পতন ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। এসময় সরকারের শীর্ষ নেতা এবং মন্ত্রীরা বলা শুরু করেন, আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ ঢুকেছে। হ্যাঁ, তৃতীয় পক্ষ না ঢুকলে তো সরকার পতন হতো না। আন্দোলনের একটি পক্ষও তো বলেছে আমরা কোটা সংস্কার চাই, সরকার পতন চাই না। যদি তৃতীয় পক্ষ প্রবেশ না করতো তবে এই আন্দোলন একটা পর্যায়ে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে যেত। প্রকৃত পক্ষে কারা সেই তৃতীয় পক্ষ তার দাবিদার অনেকজন হয়ে দাড়িয়েছে। তবে এটাই সত্যি যে সেজন্য আন্দোলনে সমাপ্তিতে খুনি হাসিনার বিদায় হয়েছে। যদি তৃতীয় পক্ষ প্রবেশ না করতো হাসিনার পতন হতো না। ১৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া দেশব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধের প্রথম ধাপ ২৮ জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে দেশজুড়ে ডাকা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজসহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজ, জেলার বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। এদিন দুপুরে কোটবাড়ী এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় শিক্ষার্থীদের। আন্দোলনকারিদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ রাবার বুলেট এবং কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ে। পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেট ও কাঁদুনে গ্যাসে অন্তত ২০ শিক্ষার্থী আহত হয়। ওই দিন বিকেল ৪টার দিকে পুলিশের সাঁজোয়া যান ও ভ্যানে আগুন দেন শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে কারফিউ জারির পর কুমিল্লার বিভিন্ন আবাসিক ছাত্রাবাসে অভিযান চালাতে থাকে পুলিশ। জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় রেলপথ অবরোধ করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আওয়াজ উডা শিরোনামের গানটি মুক্তি পায়। মুক্তির এক সপ্তাহ পর,গানটির সুরকার হান্নানকে ২৫ জুলাই নারায়ণগঞ্জ থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। নিউ ইয়র্কভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা আর্টিস্ট অ্যাট রিস্ক কানেকশন (এআরসি) গ্রেপ্তারটির নিন্দা জানায়। গানটি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় জনমহলে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মাত্র ১৩ দিনে এটি ইউটিউবে ছয় মিলিয়নেরও বেশি বার দেখা হয়, যা সে সময় বাংলাদেশে ইউটিউবে পঞ্চম সর্বাধিক দেখা গান হিসেবে স্থান পায়।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে ওই দিনের সকাল বেলার একটি চিত্র ফুটে উঠে। তাতে বলা হয়, দিনের শুরুতে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে স্বল্প সংখ্যক যানবাহনের উপস্থিতি দেখা গেছে। সকালে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, কমপ্লিট শাটডাউনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ঢাকাসহ সারাদেশে ২২৯ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এদিকে, বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকার শনির আখড়ায় নতুন করে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ। সেখানে বুধবার মধ্যরাত পর্যন্ত পুলিশের সাথে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলেছে।

যাত্রাবাড়ী ও শনির আখড়া এলাকায় সেসময় পুলিশের সাথে স্থানীয়দের ব্যাপক সংঘর্ষ হয় এবং হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজাসহ শনির আখড়ার অন্তত ২০টি জায়গায় আন্দোলনকারীরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন বলে বলছে পুলিশ।

বুধবার মধ্যরাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক টিম, শাটডাউনে দেশের সকল অফিস আদালত সব বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এদিন সড়কপথ, রেলপথ অবরোধ করা হবে, তবে অ্যাম্বুলেন্স, ইমার্জেন্সি ও গণমাধ্যম পরিবহন এই শাটডাউনের আওতামুক্ত থাকবে। এদিকে, বিবিসি’র সংবাদদাতারা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার দিনের শুরু থেকেই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়কে যানচলাচল খুবই সীমিত ছিল। সাধারণ দিনে ঢাকার অফিস আদালত খোলা থাকলে সকাল সাড়ে সাতটা থেকেই সড়কগুলোতে যানজট শুরু হয়। কিন্তু আজ সড়কে তেমন কোনও ব্যস্ততা লক্ষ করা যায়নি। বরং, রাস্তায় যানবাহন ও মানুষ, উভয়ের উপস্থিতিই লক্ষ্যনীয় মাত্রায় কম ছিল। এর আগে বুধবারই দেশের সকল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা এসেছে। তার মাঝে, ঢাকার অনেক বেসরকারি অফিসও ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ পদ্ধতিতে অফিস করছেন বলে জানা গেছে।

তবে শাটডাউনের সময় জরুরি পরিবহন ছাড়া সকল ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও, গতকাল রাতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ও মালিক সমিতি জানিয়েছে যে বৃহস্পতিবার গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রাখার নির্দেশ আছে তাদের প্রতি। যদিও সকাল নয়টায়ও রাস্তাঘাটে বাসের আধিক্য চোখে পড়েনি। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের মোড়ে মোড়ে কিছু ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল, কিছু সংখ্যক সিএনজি এবং ব্যক্তিগত গাড়ি দেখা দেছে। বিবিসি সংবাদদাতা শাহনেওয়াজ রকি জানিয়েছেন, বনানী, নতুন বাজার, প্রগতি সরণী, কুড়িল, বনানীতে যান চলাচল স্বাভাবিক দিনের তুলনায় খুবই কম এবং ব্যক্তিগত গাড়িও নেই বললেই চলে। রাস্তাঘাটে দুই একটা বাস চলতে দেখা গেলেও যাত্রীরা তাতে উঠতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। অ্যামেরিকান অ্যাম্বাসি ও রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে বাড়তি পুলিশ দেখা গেছে। এছাড়া, ঢাকার আজিমপুর, নীলক্ষেত, শ্যামলী, মহাখালী, গুলশান এলাকায়ও একই দৃশ্য দেখা গেছে। বিবিসি সংবাদদাতারা জানিয়েছেন, নীলক্ষেতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারে পুলিশের অবস্থান আছে। বিবিসি সংবাদদাতা তানহা তাসনিম জানিয়েছেন, মিরপুর থেকে বনানী - এই পুরো পথে তিনি “মাত্র তিনটি লোকাল বাস” দেখেছেন এবং বাসের জন্য অপেক্ষমান যাত্রী সংখ্যাও ছিল কম।

আন্দোলনের শুরুতে এটি শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের মাঝে সীমিত থাকলেও ক্রমে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এতে সমর্থন দেয়। এর মধ্যে বিএনপি, জাতীয় পার্টি,এবং হেফাজতে ইসলামসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল রয়েছে। হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মওলানা মীর ইদ্রিস বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, হাটহাজারী মাদরাসা থেকে বিকেল পাঁচটায় কোটা সংস্কারের দাবীতে সমর্থন জানিয়ে সমাবেশ করবে তারা। এর আগে, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বুধবার সন্ধ্যায় হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারের আলোচনা প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘গুলীর সঙ্গে কোনো সংলাপ হয় না। এই রক্তের সঙ্গে বেইমানি করার থেকে আমার মৃত্যু শ্রেয়।’

সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসবে না জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সহিংসতা চালিয়ে সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এর দায় সরকারেরই। শহীদের রক্তের ওপর কোনো সংলাপ হবে না। সরকারকেই সমাধানের পথ বের করতে হবে। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ঘটনায় ১৮ জুলাই পুলিশের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এদিন উত্তরায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশ ও র‌্যাবের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড বোমা ও রাবার বুলেট ছোড়ে। দিনভর থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে। দুপুরে আন্দোলনকারীরা উত্তরা-পূর্ব থানায় আগুন দেন।

এছাড়াও রাজধানীর মেরুল বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, ধানমন্ডি, মিরপুর-১০, নীলক্ষেত, আজিমপুর, তেজগাঁও, শান্তিনগর, মহাখালী, শনির আখড়া, কাজলা, যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দিনভর এসব এলাকা ছিল রণক্ষেত্রের মতো। শিক্ষার্থীদের ধাওয়ায় মেরুল বাড্ডায় কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতে আশ্রয় নেন পুলিশের সদস্যরা। বিকেলে তাদের হেলিকপ্টারে করে উদ্ধার করা হয়। এদিন দেশের ৪৭ জেলায় পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়।

ফায়ার সার্ভিস জানায়, বুধবার ও বৃহস্পতিবারের সহিংসতায় সারাদেশে ২৫টি স্থানে আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতেই ১৫টি। এছাড়া ছয়টি বাস, দুটি মাইক্রোবাস, ২০টি মোটরসাইকেল, সরকারি অফিস, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়, টোল প্লাজা ও থানাসহ অনেক পুলিশ বক্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছয়জন নিহত এবং সাম্প্রতিক সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়।

এদিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের শতাধিক নেতা-কর্মী পদত্যাগ করেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় ছাত্রলীগের ২৪ জন নেতা-কর্মী দল থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। ওই সময় কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক বলেন, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করা মৌলিক মানবাধিকার। বাংলাদেশ সরকারের উচিত মানুষের এ অধিকার নিশ্চিত করা। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক বলেন, ‘পরিস্থিতি বুঝেই ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের প্রশিক্ষিত ক্যাডার বাহিনী সারাদেশে এই তা-ব চালাচ্ছে। তাদের উসকানির জন্য সারাদেশে কয়েকজনকে প্রাণ দিতে হয়েছে।’রপররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চেপে বসেছে বিএনপি-জামায়াত। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আন্দোলন ছিনতাই করেছে তারা।’এদিন যশোরের কেশবপুরে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক, রাজবাড়ীতে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া ও রাজবাড়ী-ফরিদপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক, ঝালকাঠির রাজাপুরে খুলনা-বরিশাল মহাসড়ক, গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বরিশালে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।

এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক, পঞ্চগড় শহরে ঢাকা-পঞ্চগড় মহাসড়ক এবং কক্সবাজারে চট্টগ্রাম- কক্সবাজার ও কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক এবং রাঙামাটি ও লক্ষ্মীপুর শহরে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা।