সাত বছর আগে দুই ভাগ হয়ে যাওয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবার একীভূত হচ্ছে। ফলে জননিরাপত্তা ও সুরক্ষা সেবা বিভাগের কার্যক্রম একজন সচিবের অধীনেই পরিচালিত হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ একত্রীকরণ করতে সাংগঠনিক কাঠামো থেকে বিদ্যমান ১৫টি পদ বিলুপ্ত এবং ৩১টি নতুন পদসৃষ্টিসহ ৫৩৪টি পদ সৃজনের প্রস্তাব আজ সোমবার প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় উঠছে। আজ বিকাল ৩ টায় মন্ত্রী পরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুমোদন হলেই দুই বিভাগ একত্রীকরণের কাজ চূড়ান্ত রুপ নেবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এর আগে গত ৩ নবেম্বর রোববার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে একটি চিঠি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৌঁছে বলে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গতকাল রোববার দৈনিক সংগ্রামকে নিশ্চিত করেন।
এর আগে ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি জারি হওয়া এ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুনর্গঠন করে দুটি বিভাগ গঠন করেছেন। দুই বিভাগে দুইজন সচিব থাকবেন।’
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগে মোট পদ রয়েছে ৫১৮টি। এর মধ্যে জননিরাপত্তা বিভাগে ২১৬টি এবং সুরক্ষা সেবা বিভাগে ৩০২টি ক্যাডার ও নন ক্যাডার পদ রয়েছে। দুই বিভাগে বিদ্যমান ৫১৮টি পদ থেকে ৩টি ক্যাডার পদ এবং ১২টি নন ক্যাডার পদ বিলুপ্তির প্রস্তাব করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এছাড়া নতুন করে ৩১টি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির কাছে। ৩১টি নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাবে ৫টি ক্যাডার পদ স্থায়ীভাবে এবং ২৬টি নন ক্যাডার পদ অস্থায়ীভাবে বছর বছর সংরক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
দুই বিভাগ এক করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাংগঠনিক কাঠামোতে সচিবের দপ্তর ১টি, অনুবিভাগ ১৫টি, অধিশাখা ৩০টি এবং ৭৬টি শাখার জন্য বিদ্যমান ৫১৮টি পদের অতিরিক্ত ৫১টি পদ সৃজনসহ মোট ৫৬৯টি পদ অনুমোদনের প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জননিরাপত্তা বিভাগ এবং সুরক্ষা সেবা বিভাগ দুটিকে একত্রীকরণের জন্য সাংগঠনিক কাঠামোতে বিদ্যমান ৫১৮টি পদের মধ্যে ১৫টি পদ বিলুপ্ত এবং রাজস্বখাতে ৪৭টি (স্থায়ীভাবে ৫টি ক্যাডার পদ এবং অস্থায়ীভাবে অন্যান্য ৪২টি) পদ সৃজনের সুপারিশসহ ৫৫০টি (স্থায়ীভাবে ১১৯টি ক্যাডার পদ ও অস্থায়ীভাবে অন্যান্য ৪৩১টি) পদের সমন্বয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠনের সম্মতি দেয়। অর্থ বিভাগ (ব্যয় ব্যবস্থাপনা) দুই বিভাগ একত্রীকরণের জন্য সাংগঠনিক কাঠামোতে বিদ্যমান ১৫টি পদ বিলুপ্ত এবং রাজস্ব খাতে ৩১টি (২৬+৫) পদ সৃজনের সম্মতিসহ সর্বমোট ৫৩৪টি (স্থায়ীভাবে ১১৯টি ক্যাডার পদ ও অস্থায়ীভাবে অন্যান্য ৪১৫টি) পদের সমন্বয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠনের সম্মতি দেয়।
কাজের সুবিধার যুক্তিতে ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি বিভাগের নাম হয় জননিরাপত্তা বিভাগ এবং আরেকটির নাম হয় সুরক্ষা সেবা বিভাগ। জননিরাপত্তা বিভাগের অধীন রয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, তদন্ত সংস্থা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালস, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার। আর সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীন রয়েছে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর, কারা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এই বিভাগকে এক করার বিষয়টি আলোচনায় আসে। বর্তমানে সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি জননিরাপত্তা বিভাগের পাশাপাশি সুরক্ষা সেবা বিভাগেরও সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা ও সুরক্ষা সেবা বিভাগ দুটির কাজের ব্যাপকতা, অধিকতর সমন্বয়, গতিশীলতা আনা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে জনস্বার্থে একত্রীকরণে গত বছরের ৩ নবেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অনুমোদন দেন। এরপরই দুই বিভাগ একত্রীকরণের কাজ শুরু হয়। এদিকে দুই বিভাগ একত্রীকরণে সরকারের উদ্যোগে জননিরাপত্তা বিভাগ এবং সুরক্ষা সেবা বিভাগের কর্মচারীরা খুশি। তারা দ্রুত একীভূত হতে চান।
জানা গেছে, কাজের সুবিধার যুক্তিতে ২০১৭ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ‘জননিরাপত্তা বিভাগ’ ও ‘সুরক্ষা সেবা বিভাগ’ নামে ভাগ করা হয়। কিন্তু এটি হওয়ার পর সুযোগ-সুবিধা ও দায়িত্ব নিয়ে দুই বিভাগের কর্মীদের মধ্যে মতানৈক্য তৈরি হয়। এমন অবস্থায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আগের মতো একটি বিভাগে পরিণত করার উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ একীভূত করার অনুমোদন দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশনা প্রদান করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। গত বছরের ৩ নবেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পরিচালক এ কে এম মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগ একীভূত হলে ব্যয় কমে আসবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। চিঠিতে দুই বিভাগের অধীনে থাকা ১০টি দপ্তর ও অধিদপ্তর একত্রিত করে একীভূত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
২০১৪ সালে বিদেশে পাসপোর্ট প্রদানের কাজ পররাষ্ট্র থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আনা হয়। তিন বছর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দুই বিভাগে বিভক্ত করা হলে বিদেশে পাসপোর্ট অফিসে কাজ করার সুযোগ নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। পাসপোর্ট ইস্যুর কাজটি সুরক্ষা সেবা বিভাগ করে বলে এ বিভাগের কর্মীরা বিদেশে পাসপোর্ট অফিসে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আসছেন। এক পর্যায়ে উভয় বিভাগের কর্মীদের সমান হারে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দিতে পরিপত্র জারি করা হয়। বিষয়টি নিয়ে জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে উচ্চ আদালতে মামলা হয়। এতে জননিরাপত্তা বিভাগের পক্ষে রায় হয়। এর আলোকে উভয় বিভাগের মধ্যে সমহারে বিদেশে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরে সুরক্ষা সেবা বিভাগ এ নির্দেশনার বিরুদ্ধে আপিল করে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুই ভাগে ভাগ হওয়ায় কর্মকর্তাদের সুবিধা হলেও কর্মচারীদের সমস্যা হয়। সহায়ক জনবলের ঘাটতি পূরণে মন্ত্রণালয়ে অন্তত ৪০-৪৫ জন পুলিশ সদস্যের পদায়ন হয়েছিল। এ নিয়ে কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। বিক্ষুব্ধদের মত হচ্ছে, দুই বিভাগ একত্র হলে অতিরিক্ত জনবল প্রয়োজন হবে না। এদিকে, সুরক্ষা সেবার অধীনে থাকা পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন ও ইমিগ্রেশনে দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ সদস্যরা। অথচ পুলিশের পদায়নের দায়িত্বে রয়েছে জননিরাপত্তা বিভাগ। এটিও উভয় বিভাগের মধ্যে অসন্তোষের কারণ।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অর্গানোগ্রামে অতিরিক্ত সচিবের পদ রয়েছে একটি। কিন্তু গত আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসনে ব্যাপকভাবে পদোন্নতি দেওয়ায় সেখানে অতিরিক্ত সচিবের পদ রয়েছে ১৫টি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এখন কোনো মন্ত্রণালয়ই অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী চলছে না। কাজের সুবিধার যুক্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ– এ দুই বিভাগে বিভক্ত করা হয়। কিন্তু সেখানে ৮০ শতাংশ ক্ষমতা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের হাতে রয়ে যায়। এ নিয়ে বিভাগ দুটির মধ্যে চলছে দ্বন্দ্ব।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিদেশে পদায়নের সুযোগ পাওয়া না-পাওয়া এবং এক বিভাগের কর্মীদের পদায়নের দায়িত্ব অন্য বিভাগের হাতে থাকার মতো বিষয়ে দুই বিভাগের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। বাইরে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাসপোর্ট অফিস রয়েছে।