পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে এবার সড়ক নৌ ও রেল পথে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নিরাপদ, নির্বিঘ্ন করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন এই সরকারের জন্য ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করা এক রকম চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
তবে গেলো ঈদুল ফিতরের সময় ঈদ যাত্রা অনেকটা শান্তিপুর্নভাবে হয়েছে। তাই আগামী ঈদুল আযহার সময় যেন আরো স্বস্তি আনা যায় সেদিকে নজর দিয়েছে সরকার। ঈদযাত্রা উপলক্ষে নতুন সেতু ও সড়ক খুলে দিয়েছে সরকার। যানজট নিরসন, যাত্রী নিরাপত্তা, টিকিটের অতিরিক্ত দাম ও কালোবাজারি বন্ধসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো । এছাড়া কোরবানীর পশুবাহী যানবাহন যাতে নিরাপদে যেতে পারে সেদিকে নজর দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, আসন্ন পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে ঈদযাত্রা নিরাপদ, নির্বিঘ্ন এবং যানজটমুক্ত করার লক্ষ্যে পশুবাহী গাড়ি মহাসড়কের বাম পাশ দিয়ে চলাচল করবে। মহাসড়কের উপর বা পার্শ্ববর্তী চিহ্নিত সম্ভাব্য ২১৭টি পশুর হাট ইজারা দেওয়া হবে না। এছাড়া, পশুর হাটের প্রবেশমুখ সড়কের বিপরীতে হবে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিবের সভাপতিত্বে পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে সড়কপথে যাত্রী সাধারণের যাতায়াত নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করার লক্ষ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সভায় এসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
কোরবানির পশু পরিবহনের ট্রাকের সম্মুখে ব্যানার ব্যবহার করতে হবে এবং পণ্য পরিবহনকারী যানবাহনে যাত্রী বহন করা যাবে না। দুর্ঘটনা কবলিত যানবাহন দ্রুত উদ্ধারের জন্য রেকার প্রস্তুত রাখা হবে। দেশের সকল বাস টার্মিনাল ও মহাসড়কের চাঁদাবাজি বন্ধ করা এবং সড়ক পথে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটমার, মলমপার্টি, অজ্ঞার পার্টির দৌরাত্ম্য রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মোটরযানের সুশৃঙ্খল চলাচল নিশ্চিত করা এবং দুর্ঘটনা রোধকল্পে মোটরযানের নিয়ন্ত্রিত গতিসীমা নিশ্চিত করা হবে। নসিমন, করিমন, ইজিবাইকসহ সকল থ্রি-হুইলার জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে চলাচল বন্ধ করা হবে। সড়কের উভয় পাশে অস্থায়ী বাজার অপসারণ করা হবে। ফিটনেসবিহীন ও ক্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধকরণ ও মেরামতের ওয়ার্কশপসমূহে ঈদের দশ দিন পূর্ব থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।
এছাড়া, জাতীয় মহাসড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ করিডোর সমূহের আওতায় সড়ক সংস্কারের কাজ ঈদের সাত দিন পূর্বে সম্পন্ন করা হবে। ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কসহ সকল মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ ঈদের সময় সাত দিনের জন্য বন্ধ রাখা হবে। চিহ্নিত ১৪৯টি স্পটে যাটজট নিরসনে মনিটরিং টিম গঠন করে কার্যক্রম গ্রহণ এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। দেশে সকল বাস টার্মিনালে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন না করার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সওজ ও সেতু বিভাগের অধীন সকল সেতুতে টোল প্লাজা যানজটমুক্ত রাখার সার্বক্ষণিক ইটিসি বুথ চালু রাখা হবে।
এদিকে আসন্ন ঈদ উপলক্ষ্যে বিআরটিসি ঢাকা মহানগরী থেকে বিভিন্ন জেলা শহর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্পেশাল ঈদ সার্ভিস পরিচালনা করবে। ঈদের বন্ধের দিনে মহাসড়কে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লরি চলাচল বন্ধ রাখা হবে। গরুবাহী যানবাহন, নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, পচনশীল দ্রব্য, গার্মেন্টস সামগ্রী, ঔষধ, সার এবং জ্বালানি বহনকারী যানবাহনসমূহ এ নিষেধাজ্ঞার আওতামুক্ত থাকবে।
যাত্রীসাধারণের নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ এবং যানজটমুক্ত যাতায়াতের সুবিধার্থে গার্মেন্টসসহ সকল শিল্পকারখানার শ্রমিকদের পর্যায়ক্রমে ছুটি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সড়কপথে গুরুতর দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ৯৯৯-এর সহায়তায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা ও অ্যাম্বুলেন্সের সুবিধা রাখা হবে। একইসাথে স্বাস্থ্য বিভাগ হাইওয়ের পাশে অবস্থিত হাইওয়ে পুলিশকে হাসপাতালসমূহের তালিকা প্রদান করবে। সদরঘাটসহ সকল টার্মিনালে সিসিটিভি ও সার্চলাইটের সংখ্যা বাড়ানো হবে।
জানা গেছে, ঈদ উপলক্ষ্যে ফিলিং স্টেশনগুলো ঈদের দিনসহ পূর্বের সাত এবং পরের পাঁচ দিন সার্বক্ষণিক খোলা রাখা হবে। যাত্রীসাধারণের পারাপারের জন্য পর্যাপ্ত ফেরির ব্যবস্থা রাখা হবে। ঈদের ছুটি শুরুর আগের দিন এবং ছুটির দিনসমূহের জন্য একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা রাখা হবে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ফোন নম্বর, ফোকাল পারসন সংক্রান্ত তথ্যাদি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অবহিত করা হবে।
গরুর হাটের সুনির্দিষ্ট সীমানা ও ম্যাপ উল্লেখ পূর্বক ইজারা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে কোনো গরুর হাট ইজারা প্রদান করা হবে না। কোরবানির পশু পরিবহনকারী যানবাহন আনলোড করার জন্য এবং বিক্রয়কৃত পশু বহন করার জন্য হাটের ভিতর পৃথক পৃথক জায়গা খালি রাখা হবে। প্রতিটি গরুর হাটে ইজারাদারের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মীর ব্যবস্থা রাখা হবে। তাছাড়া হাটের কার্যক্রম সঠিক রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন বা জেলা মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ বাংলাদেশ পুলিশ যথাযথ পদক্ষেপ নিবে।
এদিকে আসন্ন ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে ঘরমুখো যাত্রীদের নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকলকে সর্বদা তৎপর থাকার নির্দেশ দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। যাত্রীদের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এসময় প্ল্যাটফরমে বিনা টিকিটের যাত্রী প্রবেশ প্রতিরোধ, টিকেট কালোবাজারী, বিনা টিকেটে ভ্রমণ, ঝুঁকিপূর্ণভাবে ছাদে ভ্রমণ, নির্দিষ্ট প্ল্যাটফরম ছাড়া অন্যত্র যাত্রী উঠানামা ও স্টেশন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থী যেকোনো কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের বিশেষ করে আরএনবি সদস্যদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। পাওয়ার কার, খাবার গাড়ি ও ইঞ্জিনে যেনো কোনো যাত্রী উঠতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে এবং অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সজাগ থাকতেও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
জানা গেছে, আগামী ১ জুন থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনসমূহে পর্যাপ্ত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ স্টেশনসমূহ নিয়মিত পরিদর্শন করবেন বলেও জানা গেছে।
এদিকে ঈদের আগের তিন দিন ও পরের সাত দিন নদী পথে বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল বন্ধ থাকবে।
উপদেস্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন জানান, আসন্ন ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে নৌপথে ঘরমুখো যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঈদের আগের তিন দিন ও পরের সাত দিন সব ধরনের বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকবে। এছাড়া, ঈদযাত্রায় নৌপথে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং ধারণক্ষমতার বাইরে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কোনো অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
উপদেষ্টা বলেন, প্রত্যেক লঞ্চঘাটের নিদিষ্ট স্থানে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার রেট চার্ট প্রদর্শন করতে হবে। অন্যথায় মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়, ঈদের সময় যাত্রী দের কাছ থেকে নির্ধারিত ভাড়ার বাইরে প্রায় দেড় বা দুই গুণ বেশি ভাড়া আদায় করা হয়। এ ধরনের অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সদরঘাট বা অন্যান্য ঘাটের ইজারা গ্রহণকারীরা যাত্রীদেরকে কোনোরূপ হয়রানি করতে পারবেন না।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ঈদকে সামনে রেখে ঈদুল আযহার আগে তিন দিন এবং পরে তিন দিন নিত্য প্রয়োজনীয় ও দ্রুত পচনশীল পণ্যবাহী ট্রাক ব্যতীত অন্যান্য ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ফেরিতে পারাপার বন্ধ রাখা হবে। এছাড়া, নৌপথে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা এবং উদ্ধার কার্যক্রম গ্রহণের জন্য উদ্ধারকারী জলযান প্রস্তুত থাকবে। উপদেষ্টা বলেন, যাত্রী সাধারণের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে সকল নদীবন্দর, টার্মিনাল ও ঘাটে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন থাকবে। জেলা প্রশাসকগণ টাস্কফোর্স গঠন করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবেন।
উপদেষ্টা বলেন, দূরপাল্লাগামী লঞ্চগুলোতে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে চারজন করে আনসার সদস্য নিয়োগের জন্য মালিকপক্ষকে বলা হয়েছে। এর ব্যত্যয় হলে, কোনো দুর্ঘটনা সংগঠিত হলে মালিকপক্ষ দায়ী থাকবে। লঞ্চে বা ফেরিঘাটে কর্মরত স্টাফদের নির্ধারিত ইউনিফর্ম এবং আইডি কার্ড থাকতে হবে। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী, মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া, বরিশালের মেঘনা নদীসহ অপরাধপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে কোস্ট গার্ড, নৌ পুলিশের পাশাপাশি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বিশেষ টহল থাকবে।
উপদেষ্টা বলেন, ৩০ মে হতে ১৪ জুন পর্যন্ত ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে সদরঘাট পর্যন্ত সড়ক উন্মুক্ত রাখতে হবে। কোনো ভাবেই রাস্তার উপরে যত্রতত্র বাস দাঁড় করিয়ে রাখা যাবে না। সংশ্লিষ্ট পুলিশ বাহিনী বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিং করবে। প্রয়োজনে রেকার দিয়ে অভিযুক্ত বাসগুলোকে সরিয়ে দিতে হবে। ঈদযাত্রার প্রস্তুতি দেখতে উপদেষ্টা সদরঘাটসহ নৌরুটের বিভিন্ন স্পটে আকস্মিক পরিদর্শনে যাবেন। তিনি আরো বলেন, ঈদকে সামনে রেখে আগামীকাল থেকে প্রয়োজনীয় ড্রেজিং শেষে চিলমারী-রৌমারী নৌরুটে পুনরায় ফেরি চলাচল শুরু হচ্ছে।